সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কিশোরীরা যখন পানির জন্য কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পথ হেঁটে চলতে বাধ্য হয়, তখন বিদ্যালয়ের বেঞ্চে বসে বই-খাতা হাতে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নষ্ট হচ্ছে। শুধুমাত্র অবকাঠামোগত সমস্যা নয়, এই সংকট শিক্ষার অধিকার ও শিশুর ভবিষ্যতের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
অঞ্চলের নদী, খাল ও জলাভূমি থাকা সত্ত্বেও নিরাপদ পানির অভাব ক্রমবর্ধমান। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণাক্ততার বৃদ্ধি এবং অপ্রতিস্রুত চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষের কারণে মিঠাপানির উৎস ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। তবে প্রকৃত সংকট গঠিত হয়েছে দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতা ও অবহেলার মাধ্যমে, যা পানির অভাবকে সাময়িক দুর্যোগ নয়, কাঠামোগত সমস্যা হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে এর প্রভাব চরম। স্কুলগামী শিশু, বিশেষত কিশোরীরা, প্রতিদিন শিক্ষার বদলে পানির সন্ধানে সময় নষ্ট করে। ক্লাসে অনুপস্থিতি বেড়ে যায়, পড়াশোনার ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হয় এবং দরিদ্র পরিবারে শিশুরা পাঠক্রম থেকে ক্রমশ ছিটকে পড়ে। এই সমস্যা পরিবার-নির্ভর নয়, এটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার ফল।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ যেমন পিএসএফ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন প্ল্যান্ট কিছুটা সহায়তা দেয়, তবে এগুলো খণ্ডিত ও অপ্রতুল। অনেক ক্ষেত্রেই দরিদ্র পরিবারের নাগালের বাইরে, ফলে তাদের প্রতিদিন পানি না শিক্ষা, কলসি না খাতা—এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
সমাধানে কেবল প্রকল্প নয়, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন জরুরি। উপকূলীয় বাস্তবতা বিবেচনায় দীর্ঘমেয়াদি পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে থাকবে লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ, খাস পুকুর পুনরুদ্ধার, চিংড়ি চাষ সীমাবদ্ধ করা এবং বিনা মূল্যে বা ভর্তুকিতে নিরাপদ পানি সরবরাহ। স্কুলসংলগ্ন পানি সরবরাহ, মেয়েদের ওপর গৃহস্থালির কাজের চাপ কমানো এবং নিয়মিত শিক্ষার্থী উপস্থিতি নিশ্চিত করাও অপরিহার্য।
শ্যামনগরের শিক্ষার্থীরা যদি আজও পানির সন্ধানে স্কুল হারায়, তবে তা কেবল একটি এলাকার নয়, দেশের সমগ্র শিক্ষা ও পরিকল্পনাচিন্তার সংকটকে প্রতিফলিত করবে।
সূত্র: প্রথম আলো

