আরব বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান নীতি হলো সমস্ত আরব দেশ এবং ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক ‘স্বাভাবিকীকরণ’ আনা, যাতে ফিলিস্তিনিদের তাদের উপনিবেশবাদীদের মিত্রদের দ্বারা ঘিরে ফেলা যায় এবং তাদের যেকোনো বহিরাগত সহায়তা থেকে বঞ্চিত করা যায়।
আগে, ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি (Oslo I Accord) ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (PLO)–কে একটি মুক্তি আন্দোলন থেকে ইসরায়েলের অধিকারী অবস্থানের সাব-কন্ট্রাক্টর হিসেবে রূপান্তরিত করেছিল, যাতে ফিলিস্তিনীরা নিজস্ব অধিকৃত অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকে।
এই সীমাবদ্ধকরণ কৌশলটি ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম চিরতরে স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যখন অব্যাহত থাকে, যা অক্টোবর ২০২৩-এর আল-আকসা ফ্লাড অপারেশনে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন এই কৌশল পুনর্বিবেচনা করা হয়নি বরং আরও ত্বরান্বিত করা হয়।
২০২০ সালে অ্যাব্রাহাম চুক্তি (Abraham Accords) ঘোষণা হওয়ার পর- স্বাভাবিককরণ প্রচেষ্টা কেবল আরব দেশগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এমন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে, যারা কখনোই ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায়নি, তবুও তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না।
সাম্প্রতিকতম উদাহরণে, নভেম্বর মাসে ট্রাম্প প্রশাসন কাজাখস্তানের আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তিতে যোগ দেওয়ার প্রচার করেছে, যদিও সে ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের সঙ্গে “সম্পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক” বজায় রেখেছিল।
ইন্দোনেশিয়া, যার ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই ও বলা হচ্ছে যে স্বাভাবিককরণ নিয়ে বিবেচনা করছে।
এই প্রসার ঘটে তখন যখন গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার প্রেক্ষাপটে অনেক আরব উদ্যোগ স্থবির হয়ে গেছে, বিশেষ করে সৌদি আরবের ক্ষেত্রে এবং এমনকি লিবিয়াও, যার বিদেশমন্ত্রী আগস্ট ২০২৩ এ ইতালিতে তার ইসরায়েলি সমকক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন, তখনও চলমান গণহত্যা প্রক্রিয়াটি অসম্ভব করে তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ককে আঞ্চলিক কৌশল হিসেবে এগোওয়ার অনেক আগে থেকেই এটি একটি সিওনিস্ট কৌশল হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছিল।
১৯২০-এর দশকের শুরু থেকে, সিওনিস্ট সংস্থা এই অনুমান নিয়ে কাজ করেছিল যে, “যদি ফিলিস্তিনের আরবদের কাছ থেকে সিওনিস্ট মতামতের অনুমোদন পাওয়া অসম্ভব হয়, তবে এটি সিরিয়া, ইরাক, সৌদি আরব এবং সম্ভবত মিশরের আরবদের কাছ থেকে নেওয়া উচিত।”
আজকে মনে হচ্ছে, ইসরায়েলিরা কেবল ফিলিস্তিনি নেতাদের কাছ থেকেই নয়, বরং আরব ও মুসলিম বিশ্বের নেতাদের কাছ থেকেও ধীরে ধীরে এই অনুমোদন অর্জন করছে।
সিওনিস্ট প্রেক্ষাপট-
১৯২০-এর দশকে, রিভিশনিস্ট সিওনিস্ট নেতা ভ্লাদিমির জাবোটিনস্কি (Vladimir Jabotinsky) ভুলভাবে মনে করেছিলেন যে, আরব স্বীকৃতি অর্জনের জন্য সিওনিস্ট প্রচেষ্টা ভুল।
তিনি যুক্তি দেন যে, আরব দেশগুলোর সিওনিস্ট পরাজয় নিয়ে আশা নষ্ট করার জন্য “আমাদের তাদের সমান মূল্যের কিছু দিতে হবে। আমরা কেবল দুটি জিনিস দিতে পারি: অর্থ বা রাজনৈতিক সহায়তা, বা উভয়ই।”
জাবোটিনস্কি সিদ্ধান্ত নেন যে, সিওনিস্টদের পর্যাপ্ত তহবিল নেই এবং সেই দেশগুলোকে প্রয়োজন ছিল উপনিবেশবিরোধী সহায়তা যা সিওনিস্টরা দিতে পারত না, কারণ “আমরা ব্রিটিশদের সুয়েজ নালা ও পারসিয়ান উপসাগর থেকে সরানোর বা ফরাসি ও ইতালিয়ান উপনিবেশবাদের উৎখাত নিয়ে ষড়যন্ত্র করতে পারি না। এমন দ্বৈত খেলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
জাবোটিনস্কি বোঝেননি যে, সিওনিস্টরা আরব দেশগুলোকে রাজনৈতিক সহায়তা দিতে পারে, কিন্তু উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করার জন্য নয়, বরং সম্রাটতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে নিরাপদ রাখার এবং উপনিবেশবাদের ভূমিকা আরও দৃঢ় করার জন্য।
যেসব আরব দেশ ১৯৭০-এর দশক থেকে শুরু করে ২০২০ সালের অ্যাব্রাহাম চুক্তি পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিককরণ করেছে, তার বাইরে লিবিয়া নতুন কোনো সংযোজন নয়; ইরাক ও তিউনিসিয়াও গোপন আলোচনা করেছে স্বাভাবিককরণের জন্য।
স্বাভাবিককরণের ফলাফল-
জাবোটিনস্কির বিপরীতে, ইসরায়েলি এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প বুঝতে পারেন যে, সৌদি আরবসহ আরব দেশগুলোর সঙ্গে স্বাভাবিককরণ অবশ্যম্ভাবী। সৌদি আরবের উষ্ণ সম্পর্ক এখনও আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্কের রূপ নেয়নি।
আরব বিশ্বের প্রো-স্বাভাবিককরণ পক্ষ যুক্তি দেয় যে, ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ফিলিস্তিনিদের কিছু অধিকার নিশ্চিত করতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং ১৯৬৭ সালে দখলকৃত অঞ্চলের দখল শেষ করতে প্রভাব ফেলতে পারে।
তারা আরো দাবি করে যে, এই সম্পর্ক আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি আনতে পারে।
কিন্তু গত ৫০ বছরের স্বাভাবিককরণের রেকর্ড বিপরীত প্রমাণ দিয়েছে: বিপর্যয়, যুদ্ধ, উপনিবেশ সম্প্রসারণ, প্রতিরোধ এবং গণহত্যা। স্বাভাবিককরণের ইতিহাস জটিলতা এবং বিপরীত প্রভাবগুলো দেখায়।
ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে প্রথম উদাহরণ-
১৯৭৩–১৯৭৭ সালের মধ্যে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (PLO), বিশেষ করে ফতেহ এবং ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব ফিলিস্তিন, ইউরোপে ইসরায়েলি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং অন্যান্য বামপন্থী সিওনিস্টদের সঙ্গে “সংলাপ” প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করে।
এই সময়ে, ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (PLO) বিভিন্ন গোপন পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছিল ইসরায়েলি সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য, যার মধ্যে পশ্চিম তীর এবং গাজায় একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং “ইসরায়েলি” জমিতে কোনো দাবী ছাড়াও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই প্রস্তাবগুলি সরাসরি তখনকার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইয়িতজ্যাক রাবিনকে পাঠানো হয়, যিনি তা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেন এবং ইসরায়েলিদের ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নিষেধ করেন।
স্বতন্ত্র চুক্তি ও ধ্বংসাত্মক ফলাফল-
মিশরের রাষ্ট্রপতি আনওয়ার সাদাতকে না জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় স্বতন্ত্র চুক্তি করার ফলে- ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর আধিপত্য বিস্তারে আরো স্বাধীনতা পায়।
ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি (Camp David) স্বাভাবিককরণ প্রক্রিয়া সত্ত্বেও, ইসরায়েল আরো লেবাননে আক্রমণ চালায় এবং ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (PLO)-এর সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস করে।
স্বাভাবিককরণের মাধ্যমে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি এবং আরব সহায়তা গ্রহণ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। ১৯৯৩ সালে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (PLO) এবং ১৯৯৪ সালে জর্ডান ও ইসরায়েলের স্বাভাবিককরণ পরবর্তীতে ফিলিস্তিনিদের নিজেদের জনগণের উপর দমনমূলক বাহিনী হিসেবে রূপান্তরিত করেছে।
২০২০ সালের অ্যাব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে স্বাভাবিককরণের ফলস্বরূপ, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নির্দোষভাবে গণহত্যা চালাচ্ছে, যা স্বাক্ষরিত আরব দেশগুলো প্রতিহত করেনি।
প্রো-স্বাভাবিককরণ আরবরা এখনও বিশ্বাস করছে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচেষ্টা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা আনতে পারে। কিন্তু বাস্তবে– ইসরায়েল কাতারে বোমা হামলা চালিয়েছে, সিরিয়া, লেবাননেও বোমা মারছে, জমি দখল করছে, যাদের নেতারা প্রকাশ্যে স্বাভাবিকীকরণের পক্ষে এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ অব্যাহত। স্বাভাবিককরণ ও সহযোগিতা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ নিঃশেষ করবে, এই ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে।

সূত্র: মিডল ইস্ট আইয়ের ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত। অনুবাদ করেছেন—এফ.আর.ইমরান

