মো. মাসদার হোসেন অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ। তিনি বিসিএস ক্যাডারের (বিচার) মাধ্যমে ১৯৮৩ সালের ২০ এপ্রিল তদানীন্তন মুনসেফ হিসেবে বিচার বিভাগে যোগ দেন।
১৯৯৫ সালে তিনি বিসিএস বিচার অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তখন তিনি ও তাঁর সহকর্মী বিচারকেরা নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ সংক্রান্ত একটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলাটি বর্তমানে ‘মাসদার হোসেন মামলা’ নামে পরিচিত।
মো. মাসদার হোসেন ছিলেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য। তিনি আদালত ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, পৃথক সচিবালয়, অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ-শৃঙ্খলা এবং কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নসহ নানান বিষয়ে মতামত দিয়েছেন। তিনি আদালত ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, সুশৃঙ্খল প্রশাসন বজায় রাখা এবং কার্যকর সংস্কারের গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।
মো. মাসদার হোসেন: বিচার বিভাগের সদস্যদের চাকরির ক্ষেত্রে কিছু সমস্যার বিষয়ে কথা বলতে ১৯৯৪ সালে আমরা তদানীন্তন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের কাছে গিয়েছিলাম। আমাদের বেতনকাঠামোসহ কাজের পরিবেশ আগে যা ছিল, হঠাৎ অবনমিত করা হলে বিসিএস বিচার অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী পরিষদের সদস্যরা তৎকালীন আইনমন্ত্রী মির্জা গোলাম হাফিজের সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি বললেন, কিছু করতে পারবেন না। এরও কিছুদিন আগে তৎকালীন সাবজজ শেখ জাহাঙ্গীর হোসেন বেতনবৈষম্যসহ (বেতনকাঠামো এক স্তর নিচে নামিয়ে দেওয়া) কর্মপরিবেশ অনুকূলে না থাকা নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন। এটি বেশি দূর এগোয়নি।
এসব বিষয় নিয়ে অ্যাসোসিয়েশন আলোচনায় বসে। তখন সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত হয়, আইনানুগ পন্থায় অধিকার বলবৎ করার চেষ্টা করতে হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালে অ্যাসোসিয়েশনের সব সদস্যের অভিমত গ্রহণ করে মামলাটি (রিট নম্বর-২৪২৪/ ১৯৯৫) হাইকোর্টে ১৯৯৫ সালে দায়ের করা হয়। তখন আমি অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও ঢাকার থার্ড সাবজজ ছিলাম। শুধু বেতনকাঠামোর জন্য নয়; গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আমাদের চাকরির অর্থাৎ রাষ্ট্রের পৃথক অঙ্গ হিসেবে বিচার বিভাগের যে অবস্থান থাকা উচিত, তা ছিল না। অবকাঠামোগতসহ সব বিষয়ে প্রশাসনের কাছে ধরনা দিতে হতো।
মো. মাসদার হোসেন: তখনকার রাজনৈতিক পটভূমি আমাদের অনুকূলে ছিল না, এটি বলার কোনো কারণ নেই। তৎকালীন আইনমন্ত্রী বলেছিলেন সবকিছু তাঁদের হাতে নেই, এখানে আইনগত কিছু বিষয়ও আছে। তাঁর কথায় কিছু যুক্তিও ছিল, যদিও তাঁর বক্তব্যে আমরা হতাশ হয়েছিলাম। বিচার অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিবসহ বিসিএস বিচার ক্যাডারভুক্ত ২১৮ জন বিচারক (পরে ৪৪১ জন) রিট পিটিশনটি দায়ের করেন। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের একটি। প্রশাসনের অধীন ২৯টি ক্যাডারের মতো বিসিএস (বিচার) ক্যাডারকে রাখা হয়েছিল। এতে বিচারকদের স্বতন্ত্র পরিচয় বিলুপ্ত হয়। এ জন্য আইনটিও চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। কারণ, বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের পৃথক অঙ্গ, যা প্রধান বিচারপতির অধীন থাকা উচিত।
মো. মাসদার হোসেন: ১২ দফা নির্দেশনার সব কটিই যুগান্তকারী। এর মধ্যে ৮ নম্বর দফা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই দফা অনুসারে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথক্করণের অপরিহার্য শর্ত হলো, বিচার বিভাগকে সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখতে হবে।
মো. মাসদার হোসেন: রায়ের নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, অধস্তন আদালতের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ—সবকিছু সুপ্রিম কোর্ট দেখবেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, জাপানসহ অন্যান্য দেশে বিচার বিভাগ বিচার বিভাগ কর্তৃক শাসিত হয়। বিচার বিভাগ পৃথক্করণ-সংক্রান্ত মামলার রায়ের বেশ কিছু দফা বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে অষ্টম দফাটি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। অধস্তন জুডিশিয়ারির কিছু কাজ প্রশাসন তথা আইন মন্ত্রণালয়ে নিয়ন্ত্রণে আগে যা ছিল, এখনো তা–ই রয়েছে। আমি বলব যে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের আসল কাজটাই হয়নি।
মো. মাসদার হোসেন: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথক্করণ সব সরকারই চেয়েছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে রায় বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন অধ্যাদেশ ও জুডিশিয়াল সার্ভিস–সংশ্লিষ্ট বিধিমালা ২০০৭ সালে জারি করা হয়, যার বৈধতা দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। বিচার বিভাগের উন্নয়নে অবকাঠামোসহ ভবন ও গাড়ি ইত্যাদি বিষয়ে কাজ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। তবে বিচার বিভাগ যাতে পরিপূর্ণ ক্ষমতা চর্চা না করতে পারে, সে জন্য অদৃশ্য একটা ছায়া ও শক্তি সব সময় কাজ করেছে। ব্রিটিশ সরকার যাওয়ার পর ১৩৬ বার বিচার বিভাগ পৃথক করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। দুঃখজনক, সেসব উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি।
মো. মাসদার হোসেন: বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় এখনো হয়নি। যে শক্তির কথা বলছি, তাদের কারণেই এটি হয়নি। কেননা এই ক্ষমতা তারা ছাড়তে চায় না। এই ক্ষমতা বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই মানসিকতা ৫৪ বছর ধরে চলমান। দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি আগের যে বিচার বিভাগ ছিল, অর্থাৎ নব্বই দশকের আগে, কোনো দিন কোনো মন্ত্রী-এমপি কিংবা কোনো কর্তৃপক্ষ বিচার বিভাগের ন্যূনতম পদের একজন মুনসেফ বা সহকারী জজকে টেলিফোন করার পর্যন্ত সাহস করতেন না।
মো. মাসদার হোসেন: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছাড়া কোনো সভ্য দেশ তার জনগণের কল্যাণ সাধন করতে পারে না। ভোটের অধিকার বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলেন, আইনের শাসন বলেন এবং প্রশাসনিক এখতিয়ার বলেন—এই সবই জনকল্যাণে হতে হবে। বিচার বিভাগ যদি স্বাধীন না হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক পরিবেশও নিশ্চিত হবে না। আইনের শাসনও কার্যকর হবে না।
মো. মাসদার হোসেন: অবস্থার কিছুটা হলেও পরিবর্তন হয়েছে। তবে দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৪ বছর। বিচার বিভাগের দৈন্যদশার জন্য কারা দায়ী। অতীতে বিচারক নিয়োগ নিয়ে যত যা–ই হোক না কেন, এবারের বিচারপতি নিয়োগ আইনের আলোকে দক্ষ ও মেধাবীদের নেওয়া হয়েছে।
মো. মাসদার হোসেন: ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, বিচারিক স্বাধীনতা বলতে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও বোঝাবে। যাতে বিচারকেরা নির্মোহ থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করতে পারে। বিচারকদের বেতন-সুবিধাদি এবং প্রভাবমুক্ত ভালো কর্মপরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে।
মো. মাসদার হোসেন: একটি রায় আরেকটি রায়ের পরিপূরক। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রসঙ্গ নিশ্চিতভাবেই হাইকোর্টের রায়ে এসেছে। হাইকোর্ট সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করেছেন। অর্থাৎ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল-নির্ধারণ, পদোন্নতি দান, ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত হবে। হাইকোর্ট আপিলের জন্য সার্টিফিকেট ইস্যু করেছেন। ফলে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে বিষয়টি চূড়ান্ত হবে বলে আশা করি।
মো. মাসদার হোসেন: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথক্করণ নিশ্চিতে রায়ের অষ্টম দফার নির্দেশনা অনুসারে বিচার বিভাগকে শাসন ও আইন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করার জন্য পৃথক সচিবালয় তথা প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা জরুরি। পৃথক সচিবালয় ছাড়া কোনোভাবেই বিচার বিভাগের পৃথক্করণ ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
মো. মাসদার হোসেন: নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগের পৃথক্করণে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ বলেছে, রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গগুলো থেকে বিচার বিভাগের পৃথক্করণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। যে কারণে বিচার বিভাগ পুরোপুরি পৃথক হওয়া জরুরি। তাই প্রশাসন তথা নির্বাহী থেকে পৃথক না করলে বিচার বিভাগ কোনো দিন সত্যিকার অর্থে পৃথক হবে না।
মো. মাসদার হোসেন: একেক দেশে একেক ধরনের কাঠামো রয়েছে। এর সারবত্তা হচ্ছে যে বিচার বিভাগ কর্তৃকই বিচারালয়ের বিচারকেরা নিয়ন্ত্রিত হবেন। ভারতের হাইকোর্ট (পশ্চিমবঙ্গের) পৃথক সচিবালয় রয়েছে, যা আদালত পরিচালনার প্রশাসনিক ও অন্যান্য কাজ করে থাকে। জাপানেও বিচার বিভাগ নিজেই নিজেদেরটা করে।
মো. মাসদার হোসেন: আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, একজন বিচারক তাঁর সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করেছেন, তাঁর সন্তান মাত্র ১৩ দিন ক্লাস করেছে। এ সময় তাঁকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। একজন বিচারককে বদলি করার জন্য প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী কর্মস্থলে ন্যূনতম তিন বছর রাখা উচিত। যদি কোনো অনিয়মের অভিযোগ ওঠে, সে ক্ষেত্রে কারণ দেখিয়ে অন্যত্র পাঠাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি মামলার রায়ের জন্য আগামীকাল দিন রাখলেন বিচারক। আজ তাঁকে বদলি করা হলো। তিনি রায় দিতে পারলেন না। নতুন যিনি আসবেন, তাঁকে নতুন করে আবার শুনতে হবে, আরও সময় বয়ে যাবে। এটা জনগণের ক্ষতি, বিচারকের ক্ষতি ও আর্থিক ক্ষতি। তাই শান্তিপূর্ণ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত, সার্ভিস বা স্টেশনের নিশ্চয়তা ও হুটহাট বদলি নিয়ন্ত্রণ—এসব বিষয় হাইকোর্টের অধীন থাকা উচিত। পৃথক সচিবালয় হলে এর সুফল বিচারক যেমন পাবেন, বিচারপ্রার্থীরও তেমন পাবেন।
মো. মাসদার হোসেন: এ রকম অভিযোগ উঠবে না—এমন কোনো ম্যাজিক আমাদের কাছে নেই। অভিযোগ উঠতে পারে। যেকোনো বিভাগের ভালো ও মন্দ দিকই দেখতে হবে। মন্দগুলো নিয়ন্ত্রণ করে চলতে হবে। আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, কথাটি আমাদের সমাজে চালু আছে এবং কথাটির সারবত্তাও আছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় ভেতর ও বাইরে থেকে কোনোক্রমেই যেন কেউ হস্তক্ষেপ না করতে পারে ও আক্রান্ত না হয়, সেগুলো বিবেচনা করতে হবে।
মো. মাসদার হোসেন: বিভিন্ন আইন সংস্কার, সংশোধন ও বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তিসহ দেওয়ানি মামলায় সমন ইস্যুর ক্ষেত্রে পদ্ধতি পরিবর্তনসহ বেশ কিছু বিষয়ে সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগে কমিশনের প্রস্তাবিত আইনের সুপারিশের পর আইনের মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশ এখনো আলোর মুখে দেখেনি। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বাধা মানসিকতা।
মো. মাসদার হোসেন: শতভাগ একমত। শোনা যায়, আরও বিচারককে নাকি বিদায় করা হবে। ১২ জন বিচারককে ‘চা খাইয়ে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে’—জনসাধারণের মধ্যে এমন ধারণা বিদ্যমান। যদিও এর সঠিক ব্যাখ্যা সাধারণ জনগণের কাছে নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তবে অভিযোগ আসার আগে তালিকা তৈরি করা উচিত নয়।
মো. মাসদার হোসেন: একজন আইনের ছাত্র হিসেবে যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্নপূরণের জন্য বিচার বিভাগকে আপাতদৃষ্টে পৃথক করা হলেও এখনো পৃথক কর্মপরিবেশ আসেনি। বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ এখনো প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়নি। নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার বিভাগ বিনির্মাণের জন্য একটাই পূর্বশর্ত—সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
সূত্র: প্রথম আলো

