মামুন রশীদ, প্রথিতযশা ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক, সম্প্রতি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, আর্থিক খাতের উন্নয়নে সঠিক নীতি ও স্বচ্ছ পরিচালনা অপরিহার্য।
মামুন রশীদ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন অর্থনীতি ও ব্যবসায় প্রশাসনে। তিনি প্রায় ৪০ বছর কাজ করেছেন তিনটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকে, বৈশ্বিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর মাধ্যমে। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের গভীর বিশ্লেষণ করতে সক্ষম করেছে। বিশেষ করে, তিনি বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় দেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। এসব প্রকল্পের মধ্যে ব্যাংকিং খাতের দক্ষতা বৃদ্ধি ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা অন্যতম লক্ষ্য।
বর্তমানে মামুন রশীদ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফাইন্যান্সিয়াল এক্সিলেন্সের চেয়ারম্যান। এই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের আর্থিক খাতের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে নীতি নির্ধারণে সহায়তা করে। তিনি সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, “স্বচ্ছতা, সুশাসন ও দীর্ঘমেয়াদী নীতি আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করবে। উদ্ভাবনী প্রকল্প ও শিক্ষামূলক উদ্যোগে সমন্বয় ঘটালে সাধারণ মানুষের আস্থা ও খাতের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে।”
মামুন রশীদের অভিজ্ঞতা ও বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম এবং নীতি-পরিকল্পনা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। তিনি এই খাতের উন্নয়নের জন্য সতর্ক এবং দায়িত্বশীল পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংক গড়ে তুলতে আমাদের প্রধান করণীয়গুলো কী কী বলে আপনি মনে করেন?
মামুন রশীদ: শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংক মানে শুধু নোট ছাপানোর ক্ষমতা নয়, বরং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতিনির্ধারণে স্বায়ত্তশাসন ও আর্থিক শৃঙ্খলার কার্যকর রক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আমাদের প্রধান করণীয় হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে পেশাদারত্ব, প্রযুক্তি ও জবাবদিহির সমন্বয়ে পুনর্গঠন করা।
প্রথমত, মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। যেন কোনো তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে দুর্বল ব্যাংকের লাইসেন্স নীতি, ঋণ পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ও তদারকি ব্যবস্থাকে আরো কঠোর করতে হবে। তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানবসম্পদকে উন্নত বিশ্লেষণী দক্ষতা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং প্রযুক্তিনির্ভর নীতি বাস্তবায়নে প্রশিক্ষিত করতে হবে। একই সঙ্গে ডাটাচালিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সাইবার নিরাপত্তা সক্ষমতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক যেন সরকারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে নীতিগত সিদ্ধান্তে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন অবস্থান ধরে রাখতে পারে। তবেই এটি সত্যিকার অর্থে ‘শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংক’ হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি স্বাধীনতা ও সরকারের অর্থনৈতিক নীতি—এ দুইয়ের ভারসাম্য কীভাবে রক্ষা করা যায়? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে বলে আপনি মনে করেন?
মামুন রশীদ: বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইনি কাঠামোয় স্বাধীন হলেও বাস্তবে সেই স্বাধীনতা এখনো সীমিত পরিসরে সীমাবদ্ধ। এর অন্যতম কারণ হলো সরকারের রাজস্বনীতি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির মধ্যে ভারসাম্যের অভাব। রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে সরকার প্রায়ই ব্যাংক খাত থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়, যা সরাসরি মুদ্রানীতির গতিপথে প্রভাব ফেলে। ফলে টাকার সরবরাহ বাড়ে, বাজারে তারল্যচাপ সৃষ্টি হয় এবং শেষ পর্যন্ত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়। এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে নীতি-স্বাধীনতা ও নীতি-সমন্বয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার নীতি প্রণয়নে রাজনৈতিক বিবেচনা নয়, অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
একই সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে নিয়মিত নীতি-সংলাপের ব্যবস্থা থাকা জরুরি, যেখানে রাজস্ব ব্যয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও মূল্যস্ফীতির সম্ভাব্য ঝুঁকি যৌথভাবে পর্যালোচনা করা হবে। সর্বোপরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও বোর্ডকে এমন অবস্থানে থাকতে হবে, যাতে তারা প্রয়োজনে সরকারের নীতির সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করতে পারেন এবং সাহসিকতার সঙ্গে ‘না’ বলতে পারেন—এটাই স্বাধীনতার আসল পরীক্ষা। আর্থিক স্থিতিশীলতা ও জনআস্থা রক্ষায় এ নীতি-সাহসিকতাই হতে পারে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভিত্তি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন? কার্যকর অর্থনৈতিক শাসন ব্যবস্থা গঠনে এ দুই প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
মামুন রশীদ: অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক—দুটি প্রতিষ্ঠানই অর্থনীতির দুই চাকা। একটি পরিচালনা করে রাজস্ব ও ব্যয়ের নীতি, অন্যটি নিয়ন্ত্রণ করে মুদ্রা ও আর্থিক স্থিতিশীলতা। তাই দুই প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক হওয়া উচিত সহযোগিতামূলক। তবে নীতিগতভাবে হতে হবে স্বতন্ত্র ও ভারসাম্যপূর্ণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্পূর্ণ অধীনস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে মুদ্রানীতি রাজস্বনীতির হাতে জিম্মি হয়ে যায়। যার ফল হয় মুদ্রাস্ফীতি, বাজেট ঘাটতি ও বিনিময় হারে অস্থিরতা। আবার বিপরীতে, যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাস্তবতার বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা অবস্থান নেয়, তাহলে অর্থনৈতিক নীতির সামঞ্জস্য নষ্ট হয়।
কার্যকর অর্থনৈতিক শাসন ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন এ দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নীতি-সমন্বয়, তথ্য-শেয়ারিং এবং পারস্পরিক আস্থাভিত্তিক সহযোগিতা। অর্থ মন্ত্রণালয় বড় চিত্রটি নির্ধারণ করবে—কোথায় বিনিয়োগ হবে, কীভাবে রাজস্ব বাড়ানো যাবে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখবে অর্থের প্রবাহ, মূল্যস্তর ও আর্থিক খাতের স্থিতি। দুই প্রতিষ্ঠানই যদি একে অন্যের সীমারেখাকে সম্মান করে, নিয়মিত পরামর্শ সভা করে এবং একে অন্যের লক্ষ্যকে বুঝে নীতি প্রণয়ন করে, তাহলে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ও পূর্বানুমানযোগ্যতা আসবে। উন্নত দেশগুলোর মতোই, বাংলাদেশেও এ সম্পর্কটি হতে হবে ‘সহযোগিতায় স্বাধীন’—না আধিপত্যমূলক, না প্রতিযোগিতামূলক।
ব্যাংক একীভূতকরণ বা মার্জার নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে এ প্রক্রিয়ার মূল চ্যালেঞ্জগুলো কী এবং তা সফল করতে কী ধরনের নীতিগত বা প্রশাসনিক পদক্ষেপ প্রয়োজন?
মামুন রশীদ: ব্যাংক একীভূতকরণ বা মার্জার একটি জটিল কিন্তু কার্যকর প্রক্রিয়া। বিশেষভাবে তখন, যখন খাতে অতি প্রতিযোগিতা, দুর্বল শাসন ব্যবস্থা ও উচ্চপর্যায়ের অনিয়ম দেখা দেয়। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে বর্তমানে মূল চ্যালেঞ্জ হলো—অসুস্থ ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক অবস্থান অনির্ভরযোগ্য, সম্পদের গুণমান দুর্বল এবং ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতার অভাব। এসব ব্যাংক একীভূত করতে গেলে প্রথমেই আসে ডিউ ডিলিজেন্স বা বিস্তারিত আর্থিক নিরীক্ষার প্রশ্ন, যা ছাড়া কোনো মার্জারই স্থিতিশীল হবে না। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক প্রভাব ও মালিকানার স্বার্থ এ ধরনের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে, যা পুরো প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ন করবে। তৃতীয়ত, কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা, শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ ও আমানতকারীদের আস্থা। এ তিন দিককেই একসঙ্গে সামলাতে হবে, যা প্রশাসনিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়।
এ প্রক্রিয়া সফল করতে প্রয়োজন স্পষ্ট নীতিমালা, পেশাদার মূল্যায়ন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক ভূমিকা। সরকারকে নীতিসহায়তা দিতে হবে, তবে হস্তক্ষেপ নয়। সফল মার্জারের জন্য আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার উদাহরণ হিসেবে ভারতের এসবিআই একীভূতকরণ মডেলকে অধ্যয়ন করা যেতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এ প্রক্রিয়াটি যেন আর্থিক স্থিতিশীলতার হাতিয়ার হয়, দুর্বল ব্যাংককে ‘আড়াল করার’ উপায় না হয়। তবেই একীভূতকরণ হবে টেকসই ও বিশ্বাসযোগ্য।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দক্ষতা, নেতৃত্ব ও পেশাগত প্রস্তুতি বৃদ্ধির জন্য কী ধরনের দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
মামুন রশীদ: একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল ভিত্তি হচ্ছে তার নীতিনির্ধারক ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দক্ষতা, দূরদৃষ্টি ও নেতৃত্বগুণ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখন সময় এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানবসম্পদ উন্নয়নকে কৌশলগত অগ্রাধিকারে আনার। প্রথমত, কর্মকর্তাদের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রবণতা বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জনের সুযোগ দিতে হবে, যা নিয়মিত বিদেশ প্রশিক্ষণ, এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম এবং আন্তর্জাতিক সংস্থায় স্বল্পমেয়াদি দায়িত্বের মাধ্যমে সম্ভব। দ্বিতীয়ত, পলিসি অরিয়েন্টেড রিসার্চ বা নীতিভিত্তিক গবেষণায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যেন তারা সরকারি বা বহিঃস্থ নির্দেশনার অপেক্ষায় না থেকে প্রমাণনির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তৃতীয়ত, নেতৃত্ব বিকাশের জন্য প্রয়োজন আধুনিক সাকসেশন প্ল্যানিং। যেখানে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ্য উত্তরসূরি তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে কর্মীদের মূল্যায়নে শুধু আনুগত্য নয়, বরং পারফরম্যান্স ও ইনোভেশনকে প্রধান মানদণ্ড করতে হবে।
পরিশেষে, সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো—বাংলাদেশ ব্যাংক যেন নিজস্ব একটি ‘থিংক ট্যাংক’ হিসেবে কাজ করতে পারে। যেখানে অর্থনীতিবিদ, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও ঝুঁকি বিশ্লেষকরা যৌথভাবে ভবিষ্যৎ নীতি বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। তবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্ব হবে পেশাদার, আত্মবিশ্বাসী ও বৈশ্বিক মানসম্পন্ন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নিয়োগকে ঘিরে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক বিতর্ক হয়। গভর্নর নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি কীভাবে আরো স্বচ্ছ, যোগ্যতাভিত্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক করা যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
মামুন রশীদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদটি নিঃসন্দেহে দেশের আর্থিক নেতৃত্বের প্রতীক। যিনি কেবল মুদ্রানীতির রক্ষক নন, বরং সামগ্রিক অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনারও প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আমাদের দেশে এ নিয়োগ অনেক সময় প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়ে থাকে, যা পদটির মর্যাদা ও কার্যকারিতা উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। একটি কার্যকর ও প্রাতিষ্ঠানিক নিয়োগ প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন স্বচ্ছতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচনের একটি কাঠামো। উন্নত দেশগুলোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নির্বাচনে সাধারণত একটি স্বাধীন অনুসন্ধান কমিটি কাজ করে।
যেখানে অর্থনীতি, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, তহবিল ব্যবস্থাপনা, বৈদেশিক মুদ্রার বাজার ও নীতি-প্রণয়ন বিষয়ে গভীর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই বিবেচিত হন। আমাদের ক্ষেত্রেও এমন একটি ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলা যেতে পারে, যেখানে সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে এ কমিটির মতামত বাধ্যতামূলক হবে। পাশাপাশি মেয়াদ নির্ধারণ, পুনর্নিয়োগ নীতি ও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির শর্তগুলো স্পষ্টভাবে আইন দ্বারা নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন। এতে গভর্নর নিজের অবস্থানে নীতিগতভাবে স্বাধীন থেকে অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করতে পারবেন।
প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের যুগে অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ডিজিটাল মুদ্রা, সাইবার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ও এআই-ভিত্তিক তদারকির মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ পরিবর্তনের সঙ্গে কতটা তাল মিলিয়ে চলছে?
মামুন রশীদ: বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এখন এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। যেখানে প্রযুক্তি শুধু সহায়ক নয়, বরং নীতি প্রণয়ন ও আর্থিক তদারকির কেন্দ্রবিন্দু। ডিজিটাল কারেন্সি, সাইবার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক মনিটরিং এখন উন্নত দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ক্ষেত্র। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও পরিবর্তনের এ ঢেউ স্পষ্ট। তবে এ গতি এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি (সিবিডিসি) প্রবর্তনের প্রাথমিক গবেষণা শুরু করেছে, যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। পাশাপাশি সাইবার রেজিলিয়েন্স ফ্রেমওয়ার্ক ও ব্যাংক খাতে রিয়েল টাইম মনিটরিং সিস্টেম চালুর উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এ প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে প্রয়োজন দক্ষ জনবল, আধুনিক অবকাঠামো ও ঝুঁকি পরিচালনার সংস্কৃতি, যা এখনো পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এখন আর কেবল ‘নিয়ন্ত্রক’ হিসেবে নয়, বরং প্রযুক্তিনির্ভর ইনোভেশন লিডার হিসেবে নিজেকে রূপান্তর করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন গবেষণা ইউনিটকে শক্তিশালী করা, আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়া এবং সাইবার নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া। ভবিষ্যতের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে হতে হবে ডাটানির্ভর, ডিজিটালভাবে সক্ষম ও ঝুঁকি-সচেতন। বাংলাদেশ ব্যাংককে এখন সেই দিকেই দ্রুত এগোতে হবে।
মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান ভূমিকা আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? এখানে আর কী ধরনের কাঠামোগত বা নীতিগত পরিবর্তন দরকার?
মামুন রশীদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বর্তমানে এক জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি। একদিকে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার চাপ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নীতি সুদের হার বৃদ্ধি, ডলার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ ও আমদানি সীমিতকরণের মতো পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা এখনো প্রত্যাশিত ফল দিচ্ছে না। এর একটি বড় কারণ হলো নীতির বাস্তবায়নে দেরি, বাজারে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রবাহের অভাব এবং রাজস্বনীতির সঙ্গে সমন্বয়ের ঘাটতি। মুদ্রানীতির লক্ষ্য যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হয়, তবে সেটি শুধু সুদের হার বাড়িয়ে অর্জন করা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার সুদহার নীতি, বিনিময় হার ও ঋণের প্রবাহ—এ তিন দিকের সমন্বিত কৌশল।
বাংলাদেশ ব্যাংককে এখন মুদ্রানীতি প্রণয়নে আরো তথ্যনির্ভর ও দূরদর্শী হতে হবে। নীতি বাস্তবায়নের আগে বাজার আচরণ ও মুদ্রাস্ফীতির মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বিশ্লেষণ জরুরি। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধি, নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা ও পূর্বানুমানযোগ্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মুদ্রানীতিকে শুধু ‘বার্ষিক নীতি দলিল’ হিসেবে নয়, বরং একটি ধারাবাহিক ও গতিশীল প্রক্রিয়া হিসেবে দেখতে হবে। যেখানে বাজার, রাজস্বনীতি ও আন্তর্জাতিক অর্থপ্রবাহের বাস্তবতা একসঙ্গে বিবেচনায় নেয়া হবে। তবেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে।
ব্যাংক তদারকি, ঋণ শৃঙ্খলা ও আর্থিক সুশাসন—এ তিন ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো কার্যকর করতে হলে কোন কোন সংস্কার সবচেয়ে জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
মামুন রশীদ: ব্যাংক তদারকি, ঋণ শৃঙ্খলা ও আর্থিক সুশাসন—তিনটি ক্ষেত্রই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশ্বাসযোগ্যতা ও কার্যকারিতার মাপকাঠি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নীতির দুর্বল প্রয়োগ, প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহির ঘাটতি এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভাব। প্রথমত, ব্যাংক তদারকিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর রিস্ক বেজড সুপারভিশন মডেল গ্রহণ করতে হবে। যেখানে তদারকি শুধু কাগজে নয়, বাস্তব লেনদেন পর্যায়ে তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। দ্বিতীয়ত, ঋণ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রভাবশালী ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে একই আইনি মানদণ্ড প্রয়োগ করতে হবে এবং পুনঃতফসিল নীতিকে কঠোরভাবে সীমিত করতে হবে। তৃতীয়ত, আর্থিক সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে জবাবদিহি কাঠামো শক্ত করতে হবে, যেন নীতিগত সিদ্ধান্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে নেয়া যায়।
সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি পেশাদার, তথ্যভিত্তিক ও নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য প্রয়োজন মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধি, তদারকিতে স্বয়ংক্রিয়তা আনা এবং আইন প্রয়োগে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত অবস্থান বজায় রাখা। যখন নীতি প্রয়োগে কোনো ছাড় থাকবে না, তখনই ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে এবং আর্থিক সুশাসন সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়ন হবে।
ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া বা ভিয়েতনামের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সাম্প্রতিক সময়ে যে সংস্কারগুলো করেছে, সেগুলোর কোন দিকগুলো বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
মামুন রশীদ: ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সাম্প্রতিক সময়ে যে সংস্কারগুলো করেছে, সেগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল নীতিগত স্বচ্ছতা, প্রযুক্তিনির্ভর তদারকি এবং বাজারভিত্তিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা। এসব দেশের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয়। ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক (আরবিআই) মুদ্রানীতি প্রণয়নে মনিটারি পলিসি কমিটি গঠন করে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়াকে আরো স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক করেছে, যা আমাদের ক্ষেত্রেও প্রবর্তন করা যেতে পারে। মালয়েশিয়ার ব্যাংক নেগারা আর্থিক খাতে ম্যাক্রোপ্রুডেন্সিয়াল পলিসি শক্তিশালী করে আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে, যা বাংলাদেশের জন্যও জরুরি। ইন্দোনেশিয়া ব্যাংক প্রযুক্তিনির্ভর তদারকির মাধ্যমে রিয়েল টাইম সুপারভিশন চালু করেছে, ফলে অনিয়ম দ্রুত শনাক্ত হচ্ছে। আর ভিয়েতনাম ব্যাংক সুদের হার ও বিনিময় হার ধীরে ধীরে বাজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে আর্থিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এ অভিজ্ঞতার আলোকে তিনটি শিক্ষা নিতে পারে। প্রথমত, নীতিনির্ধারণে প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তি ও ডাটাভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থা এবং তৃতীয়ত, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পেশাদার প্রশাসন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এসব দেশের সংস্কার এসেছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা থেকে। তাই আমরাও যদি ধারাবাহিকতা ও পেশাদারত্ব বজায় রাখতে পারি, তাহলেই কেবল কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভে পরিণত হতে পারে।
আগামীর বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা আপনি কীভাবে দেখেন? আগামী পাঁচ থেকে ১০ বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোন বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত বলে আপনারা মনে করেন?
মামুন রশীদ: আগামীর বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা কেবল মুদ্রানীতি প্রণয়ন বা ব্যাংক তদারকির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং এটি হবে দেশের সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতা, ডিজিটাল অর্থনীতি এবং টেকসই উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। আমার মতে, আগামী পাঁচ থেকে ১০ বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে।
প্রথমত, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বিনিময় হার স্থিতিশীলতা। এখানে ব্যাংককে বাজারভিত্তিক ও ডাটাচালিত নীতিনির্ধারণে আরো দক্ষ হতে হবে। আমাদের অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে, তাই মুদ্রানীতিও হতে হবে আরো বৈজ্ঞানিক ও পূর্বাভাসনির্ভর। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল ফিন্যান্স ও সাইবার নিরাপত্তা—মোবাইল ফিন্যান্স, ডিজিটাল ব্যাংক ও ক্রিপ্টো বাজারের বাস্তবতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর নিয়ন্ত্রক হিসেবে গড়ে উঠতে হবে এবং তৃতীয়ত, আর্থিক সুশাসন ও আস্থার পুনরুদ্ধার—ব্যাংক খাতের অনিয়ম, ঋণখেলাপি সংস্কৃতি ও প্রভাবমুক্ত তদারকি নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নীতি ও প্রয়োগ উভয় ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে।
অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দূরদৃষ্টি, পেশাদার নেতৃত্ব ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতার ওপর। যদি বাংলাদেশ ব্যাংক স্বায়ত্তশাসন, প্রযুক্তি ও সুশাসনের সমন্বয়ে কাজ করতে পারে, তবে এটি আগামী দশকে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। সূত্র: বনিক বার্তা

