অধ্যাপক এম শামীমুজ্জামান বসুনিয়া দেশের শীর্ষস্থানীয় কাঠামো প্রকৌশলী। ক্রাউন সিমেন্ট অভিজ্ঞতার আলোয় দেশের পথিকৃৎ ও অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বদের ভিডিও সাক্ষাৎকারের অংশ হিসেবে এটি নেওয়া হয়েছিল। এই সাক্ষাৎকারে শামীমুজ্জামান বসুনিয়া নানা বিষয়ে কথা বলেছিলেন। এতে উঠে এসেছিল ভূমিকম্পের প্রসঙ্গও। আজ শুক্রবার সকালে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এই প্রেক্ষাপটে তাঁর সাক্ষাৎকারের ভূমিকম্প-সংশ্লিষ্ট অংশ আলাদাভাবে নতুন করে প্রকাশ করা হলো।
শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: (১ সেপ্টেম্বর) আফগানিস্তানে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। দেখছিলাম এটা। অলরেডি ৬০০ জন মারা গেছেন। আরও অনেকের খোঁজখবর নেই।
যদি ভূমিকম্প হয়, আর যদি তার এপিসেন্টারটা যদি এখানে থাকে, তাহলে কিন্তু সিক্স ইজ আ ভেরি বিগ ওয়ান।
শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: আমি আগের সরকারের আমলে অনেক জায়গায় বক্তৃতা দিয়েছি, সেখানে আমি বলেছি, ভূমিকম্প হলে আমাদের যা হবে…এখান থেকে লোকজন ভেগে যাওয়া…। যারা বেঁচে যাবে, তারাও থাকতে পারবে না। এখানে বীভৎস অবস্থা হবে। আগুন, পানি এবং পয়োপ্রণালির যে সিস্টেম আমাদের, এগুলোর যে অবস্থা, এগুলোকে সরাতেও পারবা না। এগুলোর গন্ধে কেউ থাকতে পারবে না।
শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: আগুন তো আছেই। প্লাস এগুলোর যে অবস্থা, তুমি ক্লিয়ারই করতে পারবা না।
শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: এখানে একটা বিরাট এরিয়া…কারণ ভূমিকম্প এক্সপার্ট যেটা বলে, আমিও বিএসএর আর্থকোয়েক সোসাইটির মেম্বার। সেখানে ওরা দেখেছে যে ভূমিকম্প কত বছর পর পর একটা রিপিটেশন হয়। যে ফল্টগুলা আছে, সেগুলো মুভ করছে। প্রতিটি আলাদা মুভ করে। কোনোটা একই ডিরেকশনে মুভ করে, কোনোটা উল্টো দিকে করছে। এটার মধ্যে দুই জয়েন্টগুলো, যেগুলো আছে, এটাই হচ্ছে সবচেয়ে ডিফিকাল্ট জায়গা। ডাউকি ফল্ট আমাদের সিলেটের ওপর দিয়ে আছে, এটাও একটা। ভূমিকম্প ডেইলি হচ্ছে। ভূমিকম্পের ইতিহাস দেখলে মনে হয় যে ডেইলি ২ মাত্রা বা ৩ মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে। এগুলো আমরা ধরি না।
ফলে একটা ভূমিকম্প যদি হয়, আমি জানি না কী হবে। এখানে বড় বড় এক্সপার্ট, ওনারা যারা পড়াশোনা করেন, তাঁরা বলেন, দেড় লাখ বিল্ডিং এখানে ভালনারেবল। আমি বলব, এক্সেপ্ট ফিউ বিল্ডিংস অল বিল্ডিংস আর ভালনারেবল। ইদানিং আমাদের ডিজাইনাররা ভেরি স্ট্রং ডিজাইন করছে। এগুলো ছাড়া অল বিল্ডিংস আর ভালনারেবল। ওয়ারস্ট ভালনারেবল হচ্ছে বুয়েটের লাল বিল্ডিং গুলো। বুয়েটের যে লাল রেসিডেনশিয়াল বিল্ডিংগুলো আছে, সেগুলো হলো মোস্ট ভালনারেবল। আহ্ছানউল্লাহ হল ইজ ভেরি ভালনারেবল। এই হলের বয়স হচ্ছে এখন ৭০-৭৫ বছর। ইটের ওপরে তৈরি।
শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: এটাকে তো বিএনবিসি (বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড) এখন করতে না করে। এটাকে রেট্রোফিট করতে বলে। কারণ, এটা ওপর দিয়ে যদি মাথা হেভি হয়, নিচ (খালি) হয়, এটাকে আমরা স্ট্রাকচারালি দুর্বল বলি। এটা বিএনবিসিতে পরিষ্কারভাবে বলা আছে যে কোনটা কী হয়। এটা তো খুব দুর্বল। এটা তো আর্কিটেক্টরা…করতে চান না। বাট দিস ডেজ আর্কিটেক্টরাও ভালো কাজ করছে।
শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: একেবারে। আমার অফিস তো কনসালটিং অফিস। আমরা তো বড় বড় বিল্ডিংয়ের সঙ্গে জড়িত হই। তবে আমরা কাজ খুব কম করি। এখানে আমরা কিন্তু একেবারে ফুল অ্যানালাইসিস ছাড়া কোনো কাজ করি না। একেবারে রিজনেবল আর্থকোয়েক ধরে সেটার পরে কী হবে সেটা…
শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: ডেফিনেটলি। কারণ, মাটির তলে কী আছে, তুমি জানো না… আমাকে কয়েক দিন আগে একজন বলেছিল যে ত্রিশালে একটা ফ্যাক্টরির একটা সাইড দেবে গেছে। আমি বলেছি, আমার কাছে আগে ড্রইং নিয়ে এসো, দেখি কী কারণে হয়েছে, তারপর আমরা দেখতে যাব কি না আমাদের অফিস থেকে। এটা সয়েল টেস্ট ছাড়া কোনো বিল্ডিং করা উচিতই না। মাটিতলে কী আছে জানি না তো আমি। আর সয়েল টেস্ট করতে সবচেয়ে কম পয়সা লাগে। সয়েল টেস্টের একেবারে (বেসিক) ল্যাবরেটরি টেস্টে যেগুলো এক্সপ্লোরেশন করে, এসপিটি ভ্যালু বলি, স্ট্যান্ডার্ড পেনিট্রেশন টেস্ট। এই ক্ল্যাসিফিকেশন দিলেও আমরা স্টাডি করতে পারি।
শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: না না, এখনো করে। এটার জন্য দায়ী আমরা নিজেরাই, সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা। প্রতিটি ইউনিভার্সিটিতে ম্যাটেরিয়ালসের ওপরে যে পড়াশোনা হয় আন্ডারগ্র্যাজুয়েটে, খুব অল্প। একটা ম্যাটেরিয়াল আছে, বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস বলে। তার মধ্যে একটা চ্যাপ্টার আছে সিমেন্ট, আরেকটা চ্যাপ্টার কংক্রিট। এটা যে এত ভাস্ট…
বিলেতে যখন আমি পড়া শুরু করি, আমার সুপারভাইজার, এলেস্টার রিচি—তিনি আমাকে বাধ্য করছিলেন কংক্রিট নিয়ে পড়তে। তিনি বলছেন, তুমি তো মাস্টারি করছ ১০ বছর, তুমি কংক্রিট, এগুলো পড়ো। আমায় খুব আদর করতেন। আমি তাঁর কথামতো পড়া শুরু করি মাস্টার্স লেভেলে। বলেছেন, তোমার পরীক্ষা দেওয়া লাগবে না। আমি অনেক কোর্স করেছি। একটা কথা প্রচলিত আছে, কংক্রিট ইজ দ্য মোস্ট ওয়াইডলি ইউজড কনস্ট্রাকশন ম্যাটেরিয়াল অল ওভার দ্য ওয়ার্ল্ড। অ্যান্ড ইট ইজ দ্য মোস্ট আনপ্রেডিক্টেবল কনস্ট্রাকশন ম্যাটেরিয়াল। এই আনপ্রেডিক্টেড ম্যাটেরিয়ালটাকে তো আমরা রাস্তাঘাটে, যেখানে-সেখানে (যে রকম ইচ্ছা) কংক্রিট বানিয়ে ফেলছি।
আমরা নিজেরা বিশ্বাস করি, কংক্রিটের মধ্যে এটা মিশিয়ে বানালেই শক্ত হয়। কিন্তু তা তো না। কংক্রিট স্ট্রেংথ বলে একটা জিনিস আছে। ফর এক্সাম্পল, একটা বড় বিল্ডিং যদি হয় ১৫-২০ তলা। একটা কলামে যে লোডটা আসে, আল্টিমেটলি তো লোডগুলো কলাম দিয়ে, ওয়াল দিয়ে পার হচ্ছে। একটা কলামে যে লোডটা আসে, তার ৬০-৭০ শতাংশ দিতে হয় কংক্রিট। ভেতরে রড দিতে হয় ৩০ শতাংশ। ফলে কংক্রিটের ম্যাটেরিয়াল যদি খারাপ হয়, তাহলে তো হবে না।
শামীমুজ্জামান বসুনিয়া: বেশি পানির দিকে কংক্রিটের স্ট্রেংথ কম হয়। এগুলো অনেক কিছু তো আছে। ফলে জিনিসটা সম্বন্ধে আরও বেশি জানা উচিত। আমি এটাও বুঝি যে একটা ইউনিভার্সিটিতে কংক্রিটের ওপর চার-পাঁচটা কোর্স থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু কংক্রিটের একটি ইনস্টিটিউট করা দরকার শুধু ডিগ্রির জন্য নয়, পেশাগত চর্চার জন্যও।
এছাড়া ঢাকা শহরে আইন প্রয়োগকারীরা, এই যে রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, গাড়ি কীভাবে পার্কিং করবে, এটা সম্পর্কে শিগগির যদি সরকার ব্যবস্থা না নেয়, ইট উইল বি ভেরি ডিফিকাল্ট। কারণ, অন্য জায়গায় দেখেছি যে একটা টার্নিংয়ের মধ্যে একটা গাড়ির কতটুক জায়গা লাগবে ঘোরাতে, সেটা লাল চিহ্ন দেওয়া থাকে, আমেরিকাতেও দেখেছি। এখন এমনভাবে একটা গাড়ি পার্ক করে রাখছে যে তুমি টার্নই নিতে পারবা না, এই অবস্থা।
আর রিকশা, মোটরসাইকেল মাঝখান দিয়ে ঢুকে পড়ে। ছোট রাস্তা, দুই পাশ থেকে গাড়ি আসছে, মাঝখানে ঢুকে রাস্তা আটকিয়ে দেয়। এগুলো শিগগিরই বন্ধ করা উচিত। পাঁচ-সাত বছর আগে মিরপুর রোডের ওপর দিয়ে রিকশা চলাচল বন্ধ ছিল। এখন এ অবস্থা হয়েছে কেন? এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না? এটার জন্য যদি ট্রাফিক পুলিশ তিন গুণ করতে হয়, তা করতে হবে। অসুবিধার কী আছে! তাতে তো চাকরিও হবে। ছাত্ররা যখন নামছিল, তখন তো ট্রাফিক ঠিক ছিল। আরেকটা হচ্ছে, উল্টা দিকে যেতে পারবে না। উল্টা দিকে মোটরসাইকেলও যেতে পারবে না। কেউই যেতে পারবে না।
এটার জন্য খালি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যারা আছে, তারা নয়, তোমরাও জনমত তৈরি করতে থাকো। একবার শুনেছিলাম, ফিলিপাইনে ট্রাফিক কন্ট্রোল করার জন্য যারা আছে তারা তো আছেই, এ ছাড়াও সরকার একটা গ্রুপ বানিয়ে দিয়েছিল। যেমন ধরো, তোমাকে বা আমাকে, আমাদেরও রাস্তাঘাটে ওই পাওয়ার থাকবে যে থামাতে পারব। এ ধরনের কিছু একটা করা যায়। কিন্তু এটা করলে বিপদও আছে। লোকজন বলবে, তুই কে? আমাদের দেশে বিপদ আছে। বাট উই হ্যাভ টু ফাইন্ড আউট অলটারনেটিভ—রাস্তাঘাট কোনটা হবে, কোনটা এক লেন, দুই লেন হবে।
- গত ১ সেপ্টেম্বর তাঁর একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আনিসুল হক। সাক্ষাৎকারটি গত ২১ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে তাঁর সাক্ষাৎকারের ভূমিকম্প-সংশ্লিষ্ট অংশ আলাদাভাবে নতুন করে প্রকাশ করেছে।

