একসময়কার অত্যন্ত লাভজনক লুব্রিকেন্ট ব্লেন্ডার ও রিফাইনার কোম্পানি লুব-রেফ (বাংলাদেশ) লিমিটেডের আর্থিক অবস্থা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে কোম্পানিটি ৬৬ কোটি টাকার রেকর্ড লোকসান দেখিয়েছে।
ব্যাংক নিষেধাজ্ঞা এবং কার্যকরী মূলধনের তীব্র সংকট এই আর্থিক বিপর্যয়ের প্রধান কারণ। এর ফলে, কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারেনি। ‘নো ডিভিডেন্ড’ ঘোষণা করলেই ঢাকা শেয়ারবাজারে (ডিএসই) লুব-রেফের শেয়ারের দাম ১৮.৯০ শতাংশ কমে ১০ টাকা ৩০ পয়সায় নেমে আসে। সাধারণত একদিনে শেয়ারের দাম ১০ শতাংশের বেশি কমার সুযোগ থাকে না, কিন্তু বার্ষিক কর্পোরেট ঘোষণা কারণে এই নিয়ম এখানে প্রযোজ্য হয়নি।
কোম্পানির তথ্য অনুযায়ী, শেয়ারপ্রতি লোকসান দাঁড়িয়েছে ৪ টাকা ৫৬ পয়সা। এর একটি বড় অংশ হয়েছে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে। প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২৪) কোম্পানিটির ৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা লোকসান হলেও পরবর্তী দুই প্রান্তিকে তারা মুনাফায় ফিরে আসে। মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত প্রথম নয় মাসে নিট মুনাফা ছিল ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। পূর্ববর্তী অর্থবছরে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর কোম্পানিটি নিয়মিত মুনাফা করেছিল। ২০২০–২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ মুনাফা হয়েছিল ৩৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
২০২২ সালের অক্টোবর থেকে প্রধান ব্যাংকার সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার মাধ্যমে এলসি (ঋণপত্র) খোলায় জটিলতার কারণে কোম্পানিটি কাঁচামাল আমদানি করতে ব্যর্থ হয়। ফলে, বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি না করে স্থানীয় বিক্রেতার কাছ থেকে চড়া দামে সংগ্রহ করতে হয়েছে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে কোম্পানিটি ২০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা মুনাফা থেকে সরে এসে ১০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা লোকসান দেখেছিল। কারণ ছিল উচ্চ আর্থিক ব্যয় এবং আয়ের হ্রাস। সেই বছর কোম্পানিটি ১ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছিল।
কোম্পানির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান স্থানীয়ভাবে কম দামে কাঁচামাল সংগ্রহ করায় লুব-রেফ ‘অন্যায্য’ প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে। কার্যকরী মূলধনের সংকট এবং ব্যাংক ঋণ না পাওয়ায় একসময়ের লাভজনক কোম্পানিটি সমস্যায় পড়ে। উচ্চহারে আর্থিক ব্যয় বেড়ে ঋণের বোঝা কোম্পানিটিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বর্তমানে কোম্পানির প্রায় ৩৯৭ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সুদ পরিশোধ হয়েছে ৫০ কোটি টাকা।
কোম্পানির কর্মকর্তারা বলেন, “আমরা কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি পুনরুদ্ধার করে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছি। সরাসরি আমদানি শুরু করলে খরচ কমানো সম্ভব হবে। বর্তমানে স্থানীয় আমদানিকারক নিজস্ব মার্জিন রাখায় কাঁচামাল সংগ্রহ ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। ফলে উৎপাদন ব্যয় মারাত্মকভাবে বেড়েছে।”
লুব-রেফ তাদের আইপিও (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) থেকে সংগৃহীত অর্থের মধ্যে ১৩ কোটি ১০ লাখ টাকা সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের একটি বিশেষ নোটিশ ডিপোজিট অ্যাকাউন্টে রেখেছিল সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে। ডিএসই ওয়েবসাইটে ৯ নভেম্বর প্রকাশিত নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত এই অব্যয়িত তহবিল সুদসহ ১৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। কর্মকর্তারা জানান, “আমরা তহবিল ব্যাংকে রেখেছিলাম, কিন্তু ব্যাংক তারল্য সংকটের কারণে তা ফেরত দিতে পারেনি। একই সঙ্গে কোম্পানিরও ব্যাংকের কাছে ঋণ রয়েছে।”
নিরীক্ষকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত লুব-রেফ তার আইপিও তহবিলের মধ্যে ১৩৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যবহার করেছে, যা এপ্রিল মাসে ছিল ৯৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা। শুধু মে থেকে জুন মাসের মধ্যে ৩৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে ভূমি উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে ১৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং কার্যকরী মূলধনে ব্যয় হয়েছে ২৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
কোভিড-১৯ মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে লুব-রেফ দীর্ঘকাল ধরে তারল্য চ্যালেঞ্জের মুখে। ২০২৪ সালের মে মাসে কোম্পানিটি আইপিও তহবিলের কিছু অংশ কার্যকরী মূলধনে ব্যবহারের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন চেয়েছিল। লুব-রেফ ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং ২০০৬ সালে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। কোম্পানিটি ২০২১ সালে শেয়ারবাজার থেকে যন্ত্রপাতি ক্রয় ও বিদ্যমান ঋণ পরিশোধের জন্য ১৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল।

