ঢাকার শেয়ারবাজারে আজকের দিনটি ছিল আরেকটি কঠিন বাস্তবতার দিন। বাজার খোলার পর থেকেই লালচিহ্নে ভরা স্ক্রিন বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে—বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখনো স্থিতিশীল নয়। আস্থাহীনতা গভীর হচ্ছে এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর আশা প্রতিদিন আরও ভাঙছে।
দুই ঘণ্টার বাজার-সংখ্যা তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। লেনদেন হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজারের বেশি ট্রেডে। মোট লেনদেন ১৪.৫২ কোটি শেয়ারের, টার্নওভার ৩৬৪ কোটি টাকা। পরিমাণে লেনদেন দেখা গেলেও বাজারের শরীরে শক্তি ফেরেনি। মাত্র ৩৩টি কোম্পানি বেড়েছে, ৪৩টি ছিল অপরিবর্তিত। আর পতন হয়েছে ৩০৫টি কোম্পানির। এ যেন আর্থিক বাজারের আরেকটি দুঃখের দিন।
সূচকের পতন—আস্থাহীনতার সোজা প্রতিচ্ছবি
তিন প্রধান সূচকই আজ নেমেছে।
- DSEX কমেছে ৪০.৯২ পয়েন্ট, অবস্থান ৪,৮৮৬.৫৭
- DSES কমেছে ৯.৬১ পয়েন্ট
- DS30 কমেছে ৬.৬৮ পয়েন্ট
পতনটি কাগজে-কলমে সাধারণ মনে হতে পারে। কিন্তু DSEX দীর্ঘ সময় ৪,৯০০–এর নিচে থাকায় স্পষ্ট—বাজারের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিনিয়োগকারীদের ভয়, অনিশ্চয়তা ও দোটানা একদিনে তৈরি হয়নি। এটি দীর্ঘদিনের নীতি-অস্থিরতা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও বাজারে উন্নয়নহীনতার ফল।
দিনের গ্রাফ—সকালের ক্ষণিক সবুজ, দুপুরের রিবাউন্ড, আর শেষে লাল সমুদ্র
দিনের গ্রাফে সকালে সামান্য সবুজ দেখা গেলেও তা বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। সকাল ১০:৩০-এর পরে সূচক একটানা নেমেছে। দুপুরে সামান্য রিবাউন্ড হলেও তা ছিল কেবল উপরের প্রলেপ—বাজার শেষে আবার লালেই ডুবে গেছে।
অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীদের মতে, এমন “ডিপ–এন্ড–স্লাইট রিবাউন্ড” দিনের মানে একটাই—
- বাজারে শক্তিশালী ক্রেতা নেই
- ইনস্টিটিউশনাল প্লেয়াররা সক্রিয় নয়
- ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে বিক্রিতে ঝুঁকছেন
মার্কেট ম্যাপ—ধীরে ধীরে নিভে যাওয়া আস্থার ছবি
মার্কেট ম্যাপের দিকে তাকালেই দেখা যায় প্রায় পুরো স্ক্রিন লালে ঢাকা।
টেক্সটাইল, ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মা, ব্যাংক, ফুয়েল অ্যান্ড পাওয়ার—প্রায় সব সেক্টরই ছিল নেতিবাচক। কিছু ছোট সবুজ দেখা গেলেও তা বাজারের দিক পরিবর্তনের মতো শক্তিশালী নয়।
কোন সেক্টর উঠল, কোনটা পড়ল?
Top Sectors By Gainer চার্টে কয়েকটি সেক্টরে সামান্য উত্থান দেখা গেছে।
কিন্তু ‘Down’ কলামের লাল বার ছিল তার তুলনায় তিনগুণ বড়।
Top Sectors By Value–তে টেক্সটাইল, ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড, ফার্মা এবং ফুয়েল অ্যান্ড পাওয়ার কিছুটা টিকে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ভ্যালু থাকলেই বাজারে শক্তি ফেরে না—আজকের দিন তা স্পষ্ট করেছে।
কেন এমন পতন?
আজকের দরপতন আকস্মিক নয়। কয়েক মাস ধরে জমতে থাকা সমস্যা আজ আরও স্পষ্ট হয়েছে।
১. নীতি-অস্থিরতা—নিয়ম পরিবর্তন, কড়াকড়ি আর শিথিলতা বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করেছে।
২. ইনস্টিটিউশনাল বিনিয়োগকারীর অনাগ্রহ—বড় খেলোয়াড়রা সক্রিয় না থাকলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর ওপর চাপ বাড়ে।
৩. ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর ভয়—৩০৫ কোম্পানির পতনে তাদের মনোবল ভেঙে গেছে।
৪. দুর্বল কর্পোরেট গভর্ন্যান্স—অনেক কোম্পানির রিপোর্ট, ডিভিডেন্ড নীতি ও আচরণ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
৫. আন্তর্জাতিক চাপে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত—ডলার সংকট, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ও আন্তর্জাতিক অস্থিরতার প্রভাব বাজারেও পড়ছে।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী
আজকের লাল স্ক্রিনের প্রতিটি ঘর যেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়া দুঃসংবাদ। বহু বছর ধরে ধৈর্য ধরে থাকা বিনিয়োগকারীরাও এখন ভরসা হারাচ্ছেন।
একজন বিনিয়োগকারীর কণ্ঠে সেই হতাশা স্পষ্ট—
“আর পারছি না—বাজার আমাকে ভেঙে দিচ্ছে।”
বাজারে স্থিতি আনতে যা জরুরি
১. নীতি-স্থিতি—বাজারবান্ধব, পূর্বঘোষিত ও দীর্ঘমেয়াদি নীতি প্রয়োজন।
২. ইনস্টিটিউশনাল ফান্ড সক্রিয় করা—প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ ছাড়া বাজার ঘুরে দাঁড়ায় না।
৩. ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা—কঠোর মনিটরিং ও শাস্তি বাড়াতে হবে।
৪. বাজারে স্বচ্ছতা—ভুয়া তথ্য, ডিভিডেন্ড কারচুপি ও প্রতারণা দমন জরুরি।
৫. দৃশ্যমান রোডম্যাপ—কমপক্ষে এক বছরের পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনা প্রয়োজন।
লালচিহ্ন শুধু বাজারের নয়—হাজারো জীবনের চাপ
শেয়ারবাজারে পতন মানে কেবল সংখ্যার পরিবর্তন নয়। এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে—
- এক বাবার সঞ্চয়ের ক্ষতি
- এক মায়ের সন্তানের শিক্ষা খরচ হারানো
- এক তরুণের প্রথম বিনিয়োগে ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন
যদি এখনই নীতিনির্ধারকরা কার্যকর পরিকল্পনা না নেন, তবে এই পতন দীর্ঘমেয়াদে একটি প্রজন্মের মনোবল ভেঙে দিতে পারে।
ঢাকার পুঁজিবাজার আজ কাঁদছে।
প্রশ্ন হলো—এই কান্না কি কেউ শুনছে?
