বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে বিরল এক অধ্যায়ের দিকে এগোচ্ছে ২০২৫ সাল। বছর শেষের পথে, অথচ এখনো পর্যন্ত একটি কোম্পানিও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি। অতীতে এমন ঘটনা খুব কমই দেখা গেছে।
গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর গঠিত বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বর্তমান কমিশন এখনো সংশোধিত আইপিও বিধিমালা চূড়ান্ত করতে পারেনি। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এটাই নতুন কোম্পানিগুলোর শেয়ারবাজারে আসতে অনীহার প্রধান কারণ। ব্র্যাক ইপিএল স্টকব্রোকারেজের গবেষণা প্রধান সালিম আফজাল শাওন বলেন, ইস্যুয়ার কোম্পানি ও ইস্যু ম্যানেজাররা চূড়ান্ত তালিকাভুক্তি বিধিমালার অপেক্ষায় রয়েছেন। স্পষ্ট নিয়ম না থাকায় কেউই ঝুঁকি নিতে চাইছে না।
বিএসইসি জানিয়েছে, তারা পাবলিক ইস্যু বিধিমালায় প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজ করছে। এর লক্ষ্য হলো যোগ্যতার মানদণ্ড স্পষ্ট করা, ইস্যু ম্যানেজারদের জবাবদিহি বাড়ানো এবং স্টক এক্সচেঞ্জ পর্যায়ে যাচাই নিশ্চিত করা, যাতে শক্ত ভিত্তির কোম্পানিগুলো ন্যায্য মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে বাজারে আসে।
সংস্কারের অংশ হিসেবে গত ১৭ মাসে কমিশন প্রায় এক ডজন মুলতবি আইপিও আবেদন বাতিল করেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভাষ্য, বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই ছিল এ সিদ্ধান্তের মূল উদ্দেশ্য। তবে এর ফলে নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তির বিষয়টি কার্যত পেছনের সারিতে চলে গেছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ যে কোম্পানিটি আইপিও এনেছিল, সেটি ছিল টেকনো ড্রাগস। গত বছরের জুনে তাদের সাবস্ক্রিপশন শেষ হয়। আগের কমিশনের সময় অনুমোদিত ওই আইপিও থেকে কোম্পানিটি একশ কোটি টাকা সংগ্রহ করে।
পরিসংখ্যান বলছে, গত ১৬ বছরে গড়ে প্রতি বছর ১০টি করে কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এমনকি ২০০৭–০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেও ২৬টি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাজারে আসে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বশেষ তালিকাভুক্ত হয় বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল, ২০১২ সালে। নতুন তালিকাভুক্তি কমে যাওয়ার পেছনে আরও কিছু কারণও রয়েছে। বাজারে পর্যাপ্ত প্রণোদনার অভাব, বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পাওয়া, ব্যাংক ঋণ সহজে পাওয়া এবং আইপিও অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রতা—সব মিলিয়ে কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
এদিকে বিনিয়োগকারীদের বাজার ছাড়ার প্রবণতাও বেড়েছে। সব খাতে, এমনকি বড় কোম্পানির শেয়ারেও দরপতন চলছে। নতুন আইপিও না থাকায় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ আরও কমে গেছে। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরের পর থেকে ৪৩ হাজারের বেশি বিও হিসাব বন্ধ হয়েছে। চলতি বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক কমেছে ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। এর ওপর আবার এপ্রিল ও মে মাসে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ পারফরমার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারের মূল সমস্যা হলো বিনিয়োগযোগ্য শেয়ারের ঘাটতি। শুধু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ালেই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে না। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে হলে ভালো ভিত্তির নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত করা জরুরি।
সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেও একাধিকবার লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে আনার কথা বলা হয়েছে। এমনকি চলতি বছরের মে মাসে প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে পরামর্শ দেন। কিন্তু গত সাত মাসে বাস্তবে কোনো অগ্রগতি হয়নি। নতুন আইপিও আনতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বিভিন্ন শিল্প সংগঠনের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে। পোশাক খাত ও ওষুধ শিল্পের সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা হলেও এখন পর্যন্ত সেগুলো পরিকল্পনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর বিএসইসি ‘পাবলিক অফার অব ইক্যুইটি সিকিউরিটিজ রুলস ২০২৫’-এর খসড়া সংশোধনী নিয়ে জনমত আহ্বান করে। বিএসইসির মুখপাত্র মো. আবুল কালাম জানিয়েছেন, শিগগিরই সংশোধিত আইপিও বিধিমালা চূড়ান্ত করা হবে। আশা করা হচ্ছে, মাসের শেষ নাগাদ এর গেজেট প্রকাশ পাবে।
তার মতে, নতুন বিধিমালা ভালো পারফরম্যান্স করা কোম্পানিগুলোকে বাজারে আসতে উৎসাহিত করবে। এতে মূল্য নির্ধারণ হবে আরও স্বচ্ছ, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে এবং ইস্যুয়ারদের জন্য প্রক্রিয়াও সহজ হবে। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, বর্তমানে কোনো আইপিও আবেদন পাইপলাইনে নেই।
বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ সম্প্রতি অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠকে আশ্বাস দিয়েছেন, সংশোধিত নিয়মের আওতায় বাজারে আসা কোম্পানিগুলো ন্যায্য মূল্য পাবে। তার ভাষায়, এখন কোম্পানিগুলোর প্রস্তুতি নেওয়ার সময়। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে এবং শিগগিরই বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হবে। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের আশা, দীর্ঘ স্থবিরতার পর এই সংস্কারই হয়তো বাজারে নতুন প্রাণ ফেরাতে পারে।

