১৯৮৬ সালে ‘অ্যান’ নামের একজন ডাটা এন্ট্রি কর্মী দেখলেন তার ডেস্কে একটি আইবিএম পিসি এসেছে। এক বছরের মধ্যেই তার চাকরি চলে গেল। চার দশক পরে ‘নাটালি’ নামে একজন সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার লক্ষ্য করছেন, চ্যাটজিপিটি তার আগে লেখা পোস্টগুলো কয়েক সেকেন্ডেই তৈরি করে দিচ্ছে কিন্তু তার চাকরি হয়তো অ্যানের চেয়েও দ্রুত হারিয়ে যাবে।
জুলাইয়ে মাইক্রোসফটের গবেষকরা এমন ৪০টি পেশার তালিকা প্রকাশ করেছেন, যেগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। তালিকায় বিক্রয় প্রতিনিধি, অনুবাদক, প্রুফরিডারসহ বিভিন্ন জ্ঞানভিত্তিক পেশা রয়েছে। এটি এক আসন্ন কর্মসংস্থানের সংকেত বহন করছে। তবে গবেষকরা এবং সংবাদপত্রগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষা করেছে। তা হলো—এই পরিবর্তন লিঙ্গসমতার ওপর ভিত্তি করে হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিকস (বিএলএস)-এর তথ্য অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত পেশার প্রায় ৬০ শতাংশে নারীর সংখ্যাই বেশি।
এআই সবার কাজকেই প্রভাবিত করতে পারে কিন্তু ইতিহাস এবং পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, নারীরাই প্রথম ও সবচেয়ে দ্রুত এ ধাক্কা অনুভব করবেন। ১৯৮০-এর দশকে কম্পিউটারের আগমনে বিপুলসংখ্যক সেক্রেটারি ও ডাটা এন্ট্রি কর্মীর চাকরি হারিয়েছিল, যাদের বেশির ভাগই নারী ছিলেন। বর্তমান অটোমেশনের ঢেউও তুলনামূলকভাবে নারীদের ওপরই বেশি আঘাত হানতে পারে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে নারীর চাকরি পুরুষদের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি ঝুঁকিতে। nকম্পিউটার বিপ্লব থেকে পাওয়া শিক্ষা সতর্কবার্তা দেয়। ১৯৮০-এর দশকে প্রযুক্তির কারণে চাকরি হারানো নারীর অনেকেই আর পুরোপুরি ফিরে আসতে পারেননি। দীর্ঘ বেকারত্বের পর কম বেতনের সেবা ও পরিচর্যা খাতের কাজে যুক্ত হয়েছেন, কেউ কেউ সম্পূর্ণভাবে শ্রমবাজার থেকে সরে গেছেন। বিএলএস-এর পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, চাকরি হারানো নারীর হার পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি ছিল।
এআই-চালিত পরিবর্তন নারীদের অর্থনৈতিক পিছিয়ে থাকা অবস্থাকে আরও বাড়াতে পারে। নারীর আয় কম, সম্পদ ও সঞ্চয় কম। তাই নীতিনির্ধারকদের আগাম প্রস্তুতি নেওয়া এবং প্রভাব কমানোর নীতি গ্রহণ করা জরুরি। তবে ১৯৮০-এর দশকে সব সেক্রেটারি বা টাইপিস্ট সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হননি। যারা নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন এবং নতুন দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, তারা তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় ছিলেন।
এআই যখন মানব বুদ্ধিমত্তাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে, তখন ‘দক্ষতা উন্নয়ন’ বা আপস্কিলিং কার্যকর হবে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবুও এমন সময় আসবে, যখন এআই-সম্পর্কিত দক্ষতা থাকা কর্মীরা অন্যদের তুলনায় ভালো ফল করবেন। পিডব্লিউসির ২০২৫ গ্লোবাল এআই জবস ব্যারোমিটার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এআই-দক্ষ কর্মীরা গড়ে ৫৬ শতাংশ বেশি বেতন পান, যা এক বছর আগে ছিল ২৫ শতাংশ।
নারী শ্রমিকদের এআই-চালিত ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে হলে তাদের নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে সমপর্যায়ের দক্ষতা থাকতে হবে। তবে ব্যক্তিগত কাজে নারীরা পুরুষদের প্রায় সমান চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করলেও কর্মক্ষেত্রে ব্যবহারে বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এক জরিপে দেখা গেছে, দৈনন্দিন কাজে জেনারেটিভ এআই ব্যবহারকারী পুরুষের সংখ্যা ৩৬ শতাংশ, নারীর সংখ্যা ২৫ শতাংশ। আত্মবিশ্বাসী পুরুষ ৪৭ শতাংশ, নারীর সংখ্যা ৩৯ শতাংশ।
কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারে এ ফারাক স্পষ্ট। নারীরা প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। কোম্পানিগুলোও পুরুষদের এআই দক্ষতা বৃদ্ধিতে নারীর তুলনায় বেশি বিনিয়োগ করছে। র্যান্ডস্ট্যাডের ১২ হাজার পেশাজীবীর জরিপে দেখা গেছে, পুরুষদের ৪১ শতাংশ বলেছেন তারা এআই ব্যবহার ও প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, নারীর সংখ্যা ৩৫ শতাংশ। এআই দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ পেয়েছেন ৩৮ শতাংশ পুরুষ, ৩৩ শতাংশ নারী।
কম ব্যবহার ও কম সুযোগ—এ দ্বৈত প্রভাব নারীর জন্য মারাত্মক। কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পদোন্নতি ও কর্মী ধরে রাখার ক্ষেত্রে ‘এআই-দক্ষতা’কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। এ সমস্যা সমাধান না হলে নিয়োগকর্তারাও আইনি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন। যুক্তরাজ্যের ইক্যুয়ালিটি অ্যাক্ট-২০১০ অনুযায়ী, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে নারীর ক্ষতি করে, তা ‘পরোক্ষ লিঙ্গবৈষম্য’ হিসেবে গণ্য হবে।
ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকরা নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত—কে এআই ব্যবহার করছে? কে এআই উদ্যোগে অংশ নিচ্ছে? কে প্রশিক্ষণ পাচ্ছে? বিশ্বজুড়ে সরকার এখনো নারীদের ওপর এআই-চালিত কর্মচ্যুতি মোকাবেলায় প্রস্তুত নয়। নীতিনির্ধারকরা এআই ঝুঁকি মোকাবেলায় লিঙ্গভিত্তিক বিষয়গুলোকে অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে অ্যাজেন্ডায় রাখতে হবে। বর্তমান রাজনৈতিক বিভাজন ও দলীয় দুর্বলতার সময়ে নারী ভোটারদের আস্থা অর্জনও গুরুত্বপূর্ণ। তাই নারীরা যেন এআই-সৃষ্ট কর্মচ্যুতি ও প্রযুক্তিগত বৈষম্যের শিকার না হন—এটি নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বুদ্ধিমানের কাজ।
সূত্র: নোরিনা হার্টজ: ইউসিএল পলিসি ল্যাবে অনারারি প্রফেসর হিসেবে কর্মরত ও সেখানে এআই সম্পর্কিত গবেষণার নেতৃত্ব দেন।

