উচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত শেনঝেনের একটি পরীক্ষাগারে চীনের বিজ্ঞানীরা এমন এক যন্ত্রের প্রোটোটাইপ তৈরি করেছেন, যা তৈরি ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর চেষ্টা করে আসছে। এই যন্ত্রটি অত্যাধুনিক সেমিকন্ডাক্টর চিপ উৎপাদনের মূল প্রযুক্তি হিসেবে বিবেচিত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্মার্টফোন এবং পশ্চিমা সামরিক ব্যবস্থায় ব্যবহৃত শক্তিশালী চিপ তৈরিতে এই প্রযুক্তি অপরিহার্য।
২০২৫ সালের শুরুতে চীনা বিজ্ঞানীরা প্রোটোটাইপ যন্ত্রটি তৈরি করেন। বর্তমানে এটি পরীক্ষাধীন অবস্থায় রয়েছে এবং প্রায় পুরো একটি কারখানার মেঝেজুড়ে বিস্তৃত। প্রকল্পটির সঙ্গে পরিচিত দুই ব্যক্তির ভাষ্য অনুযায়ী, নেদারল্যান্ডসভিত্তিক সেমিকন্ডাক্টর যন্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এএসএমএলের সাবেক প্রকৌশলীদের একটি দল এই যন্ত্রটি তৈরি করেছে। তাঁরা এএসএমএলের এক্সট্রিম আলট্রাভায়োলেট বা ইইউভি লিথোগ্রাফি মেশিন রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে অনুকরণ করেছেন।
ইইউভি লিথোগ্রাফি প্রযুক্তি এখন বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিযোগিতার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। এই যন্ত্রের মাধ্যমে এক্সট্রিম আলট্রাভায়োলেট আলোর রশ্মি ব্যবহার করে সিলিকন ওয়েফারের ওপর মানুষের চুলের চেয়েও হাজার হাজার গুণ পাতলা সার্কিট খোদাই করা হয়। সার্কিট যত সূক্ষ্ম হয়, চিপ তত বেশি শক্তিশালী হয়। এই সক্ষমতা এত দিন কেবল পশ্চিমা দেশগুলোর হাতেই ছিল।
চীনের তৈরি প্রোটোটাইপ যন্ত্রটি ইতোমধ্যে ইইউভি আলো উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে। তবে এখনো এটি দিয়ে কার্যকর চিপ তৈরি সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তি।
গত এপ্রিল মাসে এএসএমএলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্রিস্টোফ ফুকে বলেছিলেন, এই প্রযুক্তিতে পৌঁছাতে চীনের অনেক বছর সময় লাগবে। কিন্তু রয়টার্স প্রথমবারের মতো যে প্রোটোটাইপের তথ্য প্রকাশ করেছে, তা ইঙ্গিত দিচ্ছে—চীন বিশ্লেষকদের ধারণার চেয়ে অনেক দ্রুত সেমিকন্ডাক্টর স্বনির্ভরতার দিকে এগোচ্ছে।
তবে বড় ধরনের কারিগরি চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে। বিশেষ করে উচ্চ নির্ভুলতার অপটিক্যাল সিস্টেম তৈরিতে চীন পশ্চিমা সরবরাহকারীদের সমকক্ষ হতে পারেনি। দুটি সূত্রের মতে, এএসএমএলের পুরোনো যন্ত্রাংশ বিকল্প উৎস থেকে সংগ্রহ করেই চীনা প্রোটোটাইপটি তৈরি করা হয়েছে। সরকারের লক্ষ্য ২০২৮ সালের মধ্যে এই যন্ত্র দিয়ে কার্যকর চিপ উৎপাদন শুরু করা। যদিও প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের মতে, ২০৩০ সালকে বাস্তবসম্মত সময়সীমা ধরা যায়।
এই অগ্রগতি সেমিকন্ডাক্টরে স্বনির্ভরতা অর্জনে চীন সরকারের ছয় বছরব্যাপী পরিকল্পনার ফল। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের অগ্রাধিকারের তালিকায় এটি শীর্ষে রয়েছে। যদিও জাতীয় লক্ষ্য প্রকাশ্য, শেনঝেনের এই ইইউভি প্রকল্পটি গোপনে পরিচালিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
চীনের সেমিকন্ডাক্টর কৌশলের অংশ হিসেবে প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, সি চিন পিংয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী দিং শ্যুয়েশিয়াং এর তত্ত্বাবধান করছেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমিশনের প্রধান। বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে দেশজুড়ে বিস্তৃত কোম্পানি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে এই প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এতে যুক্ত রয়েছেন হাজার হাজার প্রকৌশলী।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই উদ্যোগকে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পারমাণবিক কর্মসূচি ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, লক্ষ্য একটাই—চীন যেন সম্পূর্ণ দেশীয় যন্ত্র ব্যবহার করেই উন্নত চিপ তৈরি করতে পারে এবং সরবরাহ শৃঙ্খল থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে পুরোপুরি বাদ দিতে পারে।
হুয়াওয়ে, চীনের রাষ্ট্রপরিষদ, শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং ওয়াশিংটনে চীনা দূতাবাস—কেউই এ বিষয়ে মন্তব্য করেনি।
বর্তমানে কেবল একটি প্রতিষ্ঠানই পুরোপুরি ইইউভি প্রযুক্তি আয়ত্ত করেছে। সেটি হলো এএসএমএল। প্রায় ২৫ কোটি ডলার দামের এই যন্ত্রগুলো এনভিডিয়া ও এএমডির নকশা করা এবং টিএসএমসি, ইন্টেল ও স্যামসাংয়ের উৎপাদিত সবচেয়ে উন্নত চিপ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এএসএমএল ২০০১ সালে প্রথম ইইউভি প্রোটোটাইপ তৈরি করে এবং ২০১৯ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায়। এই পর্যায়ে পৌঁছাতে তাদের প্রায় দুই দশক সময় ও বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে।
২০১৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র নেদারল্যান্ডসের ওপর চাপ দেয়, যাতে এএসএমএল চীনের কাছে ইইউভি যন্ত্র বিক্রি না করে। ২০২২ সালে এই নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর হয়। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল চীনকে অন্তত এক প্রজন্ম পিছিয়ে রাখা। এএসএমএলের দাবি, তারা কখনোই চীনে ইইউভি সিস্টেম বিক্রি করেনি।
এই নিষেধাজ্ঞা পুরোনো ডিইউভি যন্ত্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করা হচ্ছে। নেদারল্যান্ডসও সংবেদনশীল প্রযুক্তিতে প্রবেশ ঠেকাতে কর্মীদের নিরাপত্তা যাচাই বাধ্যতামূলক করছে।
প্রকল্পের গোপনীয়তার কারণে সংশ্লিষ্টরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন। তাঁদের মতে, নিষেধাজ্ঞা চীনের অগ্রগতি ধীর করলেও থামাতে পারেনি।
প্রকল্পে নিয়োগ পাওয়া এএসএমএলের সাবেক প্রকৌশলীদের অনেককে ছদ্মনামে কাজ করতে হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করা হয়েছে। কর্মীদের জানানো হয়েছিল, জাতীয় নিরাপত্তার আওতাভুক্ত এই প্রকল্পের তথ্য বাইরে প্রকাশ করা যাবে না।
এএসএমএলের সাবেক অভিজ্ঞ প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীরা এই প্রকল্পের মূল শক্তি। তাঁদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান ছাড়া রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং প্রায় অসম্ভব হতো। ২০১৯ সালে বিদেশে থাকা সেমিকন্ডাক্টর বিশেষজ্ঞদের আকৃষ্ট করতে চীন বড় অঙ্কের বোনাস ও আবাসন সুবিধা দেয়।
শেনঝেনের গবেষণাগারে তৈরি প্রোটোটাইপটি আকারে এএসএমএলের যন্ত্রের চেয়েও বড়। কারণ ছোট আকারে পর্যাপ্ত সক্ষমতা পাওয়া যায়নি। প্রযুক্তিগত দিক থেকে এটি এখনো এএসএমএলের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা উন্নত অপটিক্যাল সিস্টেমের অভাব। জার্মান প্রতিষ্ঠান কার্ল জেইসের মতো সরবরাহকারীর বিকল্প তৈরি করাই চীনের জন্য সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ।
এই যন্ত্রে গলিত টিনের ওপর প্রতি সেকেন্ডে হাজার হাজারবার লেজার নিক্ষেপ করে প্রায় দুই লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্লাজমা তৈরি করা হয়। সেই আলো বিশেষ আয়নার মাধ্যমে সঠিক জায়গায় কেন্দ্রীভূত করা হয়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, চীনা একাডেমি অব সায়েন্সেসের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অপটিক্যাল ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। তবে এখনো আরও উন্নয়ন প্রয়োজন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রযুক্তিগতভাবে এটি সম্ভব। প্রশ্ন কেবল সময়ের। চীনের সুবিধা হলো, এই প্রযুক্তি ইতোমধ্যে বিশ্বে বিদ্যমান। ফলে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়নি।
প্রকল্পে প্রায় ১০০ জন তরুণ প্রকৌশলী যন্ত্রাংশ রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে কাজ করছেন। প্রতিটি ধাপ ক্যামেরায় ধারণ করা হচ্ছে। সফলভাবে যন্ত্রাংশ জোড়া দিতে পারলে বিশেষ বোনাস দেওয়া হচ্ছে।
সরবরাহ শৃঙ্খলের প্রতিটি ধাপে হুয়াওয়ে যুক্ত রয়েছে বলে জানিয়েছেন চারটি সূত্র। চিপের নকশা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত পণ্য উৎপাদন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি সক্রিয়। কর্মীদের অনেককে কর্মস্থলেই রাত কাটাতে হচ্ছে। সংবেদনশীল দলগুলোর ফোন ব্যবহারে কড়াকড়ি রয়েছে। প্রকল্পের গোপনীয়তা রক্ষায় এক দল আরেক দলের কাজ সম্পর্কে জানে না।
সব মিলিয়ে, শেনঝেনের এই গোপন প্রকল্প চীনের সেমিকন্ডাক্টর স্বনির্ভরতার পথে একটি বড় মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

