স্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ কমে এবং আমদানি চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় টাকার বিপরীতে ডলার দুর্বল হয়ে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে গত দেড় মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার কিনেছে।
১৩ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক সাত দফা নিলামের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে মোট ৯৪৮ মিলিয়ন ডলার কেনেছে। টাকার দ্রুত অবমূল্যায়ন রোধ করতে এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে আমদানি বিল পরিশোধে সহায়তা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত ডলার বিক্রি করত। এখন পরিস্থিতি উল্টো—ডলার কিনছে। গত তিন বছরে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ২৫ বিলিয়নের বেশি ডলার বিক্রি করেছে। এগুলো মূলত জ্বালানি, সার ও খাদ্য আমদানির বিল পরিশোধে ব্যবহার হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলার দুর্বল হলে রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার কিনছে বাজারে সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার জন্য। গত বছর আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর সরকার পতনের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি আমদানির জন্য ডলার সহায়তা বন্ধ করে দেয়। পরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পায়। এতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিছুটা স্বস্তি পায়। এ বছরের মার্চে রিজার্ভ বাড়তে শুরু করলে এবং টাকার দরপতন কমে আসলে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার কেনা শুরু করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “ডলার কেনার উদ্দেশ্য হলো বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখা।
অতিরিক্ত ঊর্ধ্বগতি বা নিম্নগতি কোনোটাই বাজারের জন্য ভালো না।” এর আগে, গত মে মাসে ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির শর্ত পূরণে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করে। এর এক বছর আগে তারা ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করেছিল—যেখানে বিনিময় হার একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করত।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার থাকলেও ডলার প্রতি ১২৩ টাকার ওপরে গেলে বা ১২১ টাকার নিচে নেমে গেলে তারা হস্তক্ষেপ করবে এবং বিনিময় হারের সীমা ধরে রাখবে। গত সোমবার ডলারের দর ছিল ১২১ টাকা ৭২ পয়সা। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, রিজার্ভ পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে ডলার কেনা হয়েছে। কারণ, রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেলে আমদানি বিল পরিশোধে দেশের সক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। এ বছর উচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং আমদানি হ্রাসের ফলে রিজার্ভ আবার বাড়তে শুরু করে। আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, ২৮ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৬.১৯ বিলিয়ন ডলারে। গত বছরের একই সময়ে এটি ছিল ২০.৫৯ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানিয়েছেন, “বাজারে অতিরিক্ত অস্থিরতা ঠেকাতেই আমরা হস্তক্ষেপ করি। অতি উত্থান বা পতন কোনোটাই ভালো সূচক না। ডলার অতিরিক্ত দুর্বল হলে রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান বলেন, কম বিনিয়োগ এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হ্রাসে ডলারের চাহিদা কমেছে। তিনি বলেন, “এই পরিস্থিতিতে টাকার দাম বাড়তে পারে। তবে প্রতিযোগিতা বজায় রাখতে ডলার কিনে কৃত্রিমভাবে চাহিদা তৈরি করা হচ্ছে। এতে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স সহায়তা পাচ্ছে এবং রিজার্ভ বাড়ছে।”
তিনি আরও বলেন, “আগামী দিনে কোনো ধাক্কা এলে কর্তৃপক্ষ তা সামাল দিতে পারবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আগামী ছয় মাসের জন্য এটি সঠিক কৌশল। রিজার্ভ বাড়াতে ডলার কেনা মানে রেমিট্যান্স ও রপ্তানির ইতিবাচক ধারা ধরে রাখা।”

