ইসলামী ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টে ৫৪৯ কোটি টাকারও বেশি এক বছর ধরে জমে রয়েছে। অ্যাকাউন্টটি খোলা একটি সন্দেহজনক শেল কোম্পানির নামে কিন্তু এই বিপুল অর্থের প্রকৃত মালিক কে—এটি এখনও শনাক্ত করতে পারেননি তদন্তকারী সংস্থা এবং ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ফলে পুরো ঘটনাটি ঘিরে অর্থপাচারের নতুন সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।
টপ টেন ট্রেডিং হাউসের রহস্যময় অ্যাকাউন্ট:
২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখায় “টপ টেন ট্রেডিং হাউস” নামে অ্যাকাউন্টটি খোলা হয়। ব্যাংকের নথিতে মালিক হিসেবে আলমাস আলী–এর নাম উল্লেখ করা আছে। প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধিত ঠিকানা—ঢাকার যাত্রাবাড়ীর ২৩/৫ গোপালবাগ আবাসিক ভবনে। গত এক বছরে ব্যাংক কর্মকর্তারা ছয়বার নোটিশ পাঠিয়েছেন কথিত অ্যাকাউন্টধারীকে ব্যাংকে হাজির হওয়ার জন্য কিন্তু তিনি একবারও উপস্থিত হননি। কর্মকর্তারা তাঁর দেওয়া স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানায় গিয়ে খোঁজ নিয়েও তাঁর অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে পারেননি। এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে—অ্যাকাউন্টটি আদৌ কে খোলেছে?
ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন বলেন, এই অ্যাকাউন্টের মালিক কখনোই ব্যাংকে আসেননি। আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি, তিনি বাস্তবেই আছেন কি না।” তিনি আরো বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, এস আলম গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে ধারণা করা কয়েকটি পক্ষ ওই অ্যাকাউন্ট থেকে ভুয়া ভাউচার ও চেক ব্যবহার করে টাকা তুলতে চেষ্টা করেছে। এমনকি তারা ব্যাংক কর্মকর্তাদের ঘুষও দিতে চেয়েছে। তবে কারা এসব করেছে তিনি তা উল্লেখ করেননি।
জামাল উদ্দিন আরো যোগ করেন, “অ্যাকাউন্ট খোলার সময় আমি এখানে ছিলাম না। যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা জানিয়েছেন যে যথাযথ নথি যাচাই ছাড়াই চাপের মুখে অ্যাকাউন্টটি খোলার নির্দেশ পেয়েছিলেন।” তদন্তকারীরা এখন যাচাই করছেন—এই বিপুল অর্থ কোথা থেকে এসেছে এবং কার স্বার্থে ‘অদৃশ্য’ মালিকের নামে অ্যাকাউন্টটি খোলা হয়েছিল।
এস আলমের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা:
এই ঘটনার তদন্ত করছে দুদক। দুদকের তদন্তে টপ টেন ট্রেডিং হাউসের নথি বিশ্লেষণ করে আরও দুটি শেল কোম্পানি শনাক্ত করেছে—আলম ট্রেডিং এন্ড বিজনেস হাউস এবং গোল্ড স্টার ট্রেডিং হাউস, যা এস আলম গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। দুদকের তদন্তে দেখা গেছে, টপ টেনের অ্যাকাউন্টে একাধিকবার সরাসরি অর্থ জমা হয়েছে এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানি থেকে, যার মধ্যে রয়েছে—এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেড, সোনালি ট্রেডার্স, এস আলম এডিবল অয়েল লিমিটেড, এবং এস আলম সুগার রিফাইনারি লিমিটেড। দুদকের ঢাকা অফিসের সহকারী কমিশনার মাহমুদুল হাসান ১৮ আগস্ট চট্টগ্রাম ইন্টিগ্রেটেড অফিসে এই সন্দেহজনক অ্যাকাউন্ট নিয়ে মামলা দায়ের করেন।
এই মামলার সন্দেহভাজনদের মধ্যে আছেন তিনটি শেল কোম্পানির নামমাত্র মালিকদের সঙ্গে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম, সাবেক ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর আকিজ উদ্দিন, এবং সাবেক এক্সিকিউটিভ ভাইস-প্রেসিডেন্ট মিফতাহ উদ্দিন।
দুদক মামলাটি দায়ের করেছে ইসলামী ব্যাংক তাদের সন্দেহজনক অ্যাকাউন্টের বিষয়ে দুদককে সতর্ক করার পর। একটি চিঠিতে ব্যাংক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে স্বীকার করেছে যে, অ্যাকাউন্ট খোলার সময় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। চিঠিতে বলা হয়েছে, “এস আলম গ্রুপ সংস্থার নামে করা বিনিয়োগ থেকে উল্লেখযোগ্য অঙ্কের অর্থ অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়েছে। যদিও লেনদেন কাগজে ব্যাংকের বিনিয়োগ গ্রাহকদের সরবরাহকারীদের জন্য প্রদত্ত অর্থের মতো দেখাচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত এর লাভগ্রাহক ছিলেন এস আলম গ্রুপ এবং কিছু সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা যারা এই লেনদেনে সহায়তা করেছিলেন।”
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সাবেক ইসলামী ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর আকিজ উদ্দিন এবং এস আলম গ্রুপের সিনিয়র নির্বাহীরা টপ টেন ট্রেডিং হাউস ও অন্যান্য শেল কোম্পানির নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে বড় অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেছেন এবং অবৈধ আর্থিক লেনদেন লুকিয়েছেন।
নকল ভাউচার ও পে-অর্ডার:
ব্যাংক ও দুদকের নথি অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১৭ জানুয়ারি টপ টেন ট্রেডিং হাউসের অ্যাকাউন্ট থেকে ২০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয় সাউথইস্ট ব্যাংকের রাবেয়া এন্টারপ্রাইজে। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক নাসির উদ্দিন, যিনি এস আলম গ্রুপের প্রভাবশালী ব্যক্তি আকিজ উদ্দিনের বোন শারমিন আক্তারের স্বামী।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের দাবি, আকিজ উদ্দিন ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক এবং এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন অন্যান্য ব্যাংকের ওপর বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ রাখতেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলের পর তিনি দুবাই চলে গেছেন। দুদকের তদন্তকারীরা অনুমান করেছেন, ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে অ্যাকাউন্ট খোলার পর ১৮ মাসে কমপক্ষে ৬০০ কোটি টাকা জমা হয়েছে টপ টেনের অ্যাকাউন্টে, যা হয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, নকল ভাউচার ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে।এস আলম গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সরাসরি অর্থ স্থানান্তর করা হয়নি। এর পরিবর্তে টাকার উৎস গোপন রাখতে প্রথমে বিভিন্ন শেল কোম্পানির মাধ্যমে ঘুরিয়ে পরে টপ টেনের অ্যাকাউন্টে ঢোকানো হয়।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের ২ জুলাই ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় আলম ট্রেডিং-এর অ্যাকাউন্ট থেকে ৫২৩.১০ কোটি টাকা নগদ উত্তোলন করা হয়। একই পরিমাণ টাকা তিনটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে গোল্ড স্টার ট্রেডিং কোম্পানির অ্যাকাউন্টে জমা হয় একই শাখায়। ঠিক এক মাস পর, ৬ আগস্ট গোল্ড স্টার থেকে ৫৪৪ কোটি টাকা ভাউচারের মাধ্যমে টপ টেনের অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়, মামলা সংক্রান্ত নথি অনুযায়ী।
এই লেনদেনগুলো ব্যাংকের নিয়ম ভঙ্গ করেছে, কারণ পে-অর্ডার অবশ্যই যে প্রতিষ্ঠান ইস্যু করেছে তার নিজস্ব অ্যাকাউন্টে জমা হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে তা ঘুরে টপ টেনে জমা হয়েছে। দুদক এই প্যাটার্নকে অবৈধ অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থপাচার হিসেবে চিহ্নিত করেছে।তদন্তে দেখা গেছে, আলম ট্রেডিং এবং গোল্ড স্টার ট্রেডিং—দুটি প্রতিষ্ঠানই শেল কোম্পানি। ব্যাংকের নথি অনুযায়ী, আলম ট্রেডিং-এর মালিক নুরুল আলম, চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা এবং গোল্ড স্টার ট্রেডিং-এর মালিক বেদারুল ইসলাম, ফটিকছড়ি। এই দুটি অ্যাকাউন্টে ২,০০০ কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়েছিল। বর্তমানে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে এই অ্যাকাউন্ট দুটি ফ্রিজ করা হয়েছে, জানালেন ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার সিনিয়র সহকারী ভাইস-প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ আজিম।
একজন সিনিয়র ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার আগে বেশিরভাগ টাকা ইতিমধ্যেই উত্তোলন করা হয়েছিল, ফলে মাত্র প্রায় ২ কোটি টাকা অ্যাকাউন্টে অবশিষ্ট ছিল। একাধিক ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তারা এস আলম গ্রুপের কোনো লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেননি। তবে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর পরিস্থিতি বদলে গেছে। এখন পর্যন্ত ২০০টির বেশি সন্দেহজনক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে, যা এস আলম গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত।
ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন বলেন, “এস আলম-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলো শেল কোম্পানির মাধ্যমে প্রায় ৫২,০০০ কোটি টাকা ইসলামী ব্যাংক থেকে আত্মসাৎ করেছে। টপ টেন ট্রেডিংয়ের অ্যাকাউন্টেও এই ধরনের ঋণের টাকা এসেছে। বর্তমানে বকেয়া ঋণের বিপরীতে এই অর্থ সমন্বয়ের প্রক্রিয়া চলছে।

