দক্ষিণ এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ এবং ভারত। দীর্ঘদিন ধরে পানি বণ্টন নিয়ে এক কঠিন সমস্যার মুখোমুখি। দু’দেশের মধ্যে নদী পানি ভাগাভাগির বিষয়ে বহু বিতর্ক এবং বিরোধ রয়েছে। যার ফলে বন্যা, খরা, কৃষি উৎপাদন, পানির সংকট এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের মত ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে। এর মধ্যে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, তিস্তা, কাবেরি, সঙ্গী ও চুম্বার নদীসহ অন্যান্য নদী উল্লেখযোগ্য। নদীগুলির উপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবহারের অধিকার নিয়ে গত কয়েক দশকে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
এই প্রতিবেদনে আমরা বিশ্লেষণ করবো বাংলাদেশের পানি সংকট, পানি বণ্টনের চ্যালেঞ্জ, এর প্রভাব এবং সমাধান প্রক্রিয়া সম্পর্কে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং পররাষ্ট্রনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক প্রভাবগুলোর আলোচনা করব।
বাংলাদেশ-ভারত পানি বণ্টন সমস্যার ঐতিহাসিক পটভূমি-
বাংলাদেশের পানি সমস্যা মূলত ভারতের সঙ্গে ৫৪টি নদী ভাগাভাগির উপর নির্ভরশীল। ভারতের মধ্যে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীর জলাধার এবং তাদের উপর ভারতীয় নীতির প্রভাব বাংলাদেশের পানি সংকটকে বাড়িয়ে তুলেছে। ভারতের অভ্যন্তরে পানি ব্যবহার এবং বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের নদীগুলির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে আসছে। এই সংকটের জটিলতা এবং সীমাবদ্ধতা একদিকে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা, পরিবেশ এবং জনগণের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক জলনীতির ক্ষেত্রেও চাপ সৃষ্টি করছে।
গঙ্গা চুক্তি (১৯৯৬)-
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সাথে ভারত একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। যা গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ছিল। এই চুক্তি অনুযায়ী, গঙ্গা নদীর পানি দুই দেশের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করা হয়। তবে বাস্তবতা কখনোই মসৃণ ছিল না। গঙ্গার পানি সংকট এবং ভারতীয় নদী ব্যবস্থাপনা নানা কারণে বাংলাদেশের প্রতি ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে। এছাড়া চুক্তির শর্তাবলী বাস্তবায়নে নিয়মিত সহযোগিতা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে।
তিস্তা চুক্তির অমীমাংসিত অবস্থা-
তিস্তা নদী বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী। কিন্তু ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপর এই নদীর অনেক অংশ নিয়ন্ত্রণের কারণে পানি বণ্টনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ২০১১ সালে তিস্তা নদী নিয়ে একটি চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত হলেও, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পক্ষ থেকে একে স্বীকৃতি না দেওয়ার ফলে চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশের কৃষকরা এই নদীর উপর নির্ভরশীল কিন্তু ভারতের জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার কারণে তিস্তার পানি কমে যাওয়ার ফলে কৃষি উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা-
বাংলাদেশের কৃষি প্রধান অর্থনীতি, যেখানে বড় একটি অংশ নদীভিত্তিক সেচ ব্যবস্থা উপর নির্ভরশীল। তিস্তা, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং অন্যান্য নদীসমূহের পানি সংকট কৃষি উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। গ্রীষ্মকালীন চাষের জন্য পানি প্রয়োজন হলেও তিস্তা নদীসহ অন্যান্য নদীর পানির স্তর সংকুচিত হওয়ায় সেচ ব্যবস্থায় সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তিস্তার পানি কমে যাওয়ায় রাবী ও আমন চাষের ফলনও প্রতিনিয়ত কমছে। যা বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
পরিবেশগত বিপর্যয়-
বাংলাদেশের দেলটা অঞ্চলে নদীর পানি কমে যাওয়ার কারণে পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, নদীভিত্তিক বাস্তুতন্ত্র এবং সামুদ্রিক প্রাণী যেমন হাঙ্গর, মাছ ও কচ্ছপের প্রজননক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া, নদীর পানি কমে যাওয়ার ফলে জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা কৃষির জন্য আরও বেশি হুমকি তৈরি করছে।
শহুরে পানি সংকট-
ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী সহ দেশের অন্যান্য বড় শহরগুলোর পানির যোগানও আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। পানি সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ প্রায় পুরোপুরি নদী নির্ভর। গঙ্গা ও তিস্তার পানি কমে যাওয়ার ফলে শহুরে এলাকায় পানি সংকট বাড়ছে, যা জীবনযাত্রার মানের উপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক জলনীতি-
বাংলাদেশের পানি সমস্যা শুধুমাত্র দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয় বরং এটি একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, পানি বণ্টন কখনোই শুধুমাত্র একটি দেশের স্বার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। জলসম্পদের ভাগাভাগি দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক, আঞ্চলিক শক্তি ভারসাম্য এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়।
এশিয়ার বৃহত্তম নদী সংস্থা GBM-
গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা (GBM) একটি বৃহত্তম নদী গোষ্ঠী হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ এবং ভারতের জন্য এই নদীগুলি জাতিগত এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু। ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলো বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম এবং ত্রিপুরা নদী পানির যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। যা বাংলাদেশে পরিবেশগত বিপর্যয়ের সৃষ্টি করছে।
সমাধান: কী করা যেতে পারে?
বাংলাদেশ এবং ভারতের পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান কোনভাবেই সহজ নয়। কিন্তু একটি যৌথ ও সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ খোলা যেতে পারে।
দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা-
দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এবং চুক্তি সমাধানের জন্য অন্যতম প্রধান কৌশল হতে পারে। গঙ্গা চুক্তির মতো, একটি শক্তিশালী এবং দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি তিস্তা ও অন্যান্য নদী নিয়ে গঠন করা উচিত। দুই দেশের মধ্যে পানি ব্যবহারের প্রাধান্য, খরার সময় পানি শেয়ারিং এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে একটি কৌশলগত প্ল্যান তৈরি করা প্রয়োজন।
নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা-
বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে পানি সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমন্বিত পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। নদীভিত্তিক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করার মাধ্যমে পানির সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব।
ক্লাইমেট চেঞ্জ এবং নদী গবেষণা-
জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৃষ্টিপাতের গতিপথ পরিবর্তনের বিষয়টি একেবারে গুরুত্বপূর্ন। এই বিষয়ে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক এবং গবেষণামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দুই দেশ একযোগভাবে নদী গবেষণা করে একটি কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে।
বাংলাদেশ এবং ভারতের পানি বণ্টন সমস্যা একটি দীর্ঘস্থায়ী, জটিল এবং বহুমাত্রিক ইস্যু। নদী, কৃষি, পরিবেশ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি-সব মিলিয়ে এটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ইস্যু। এই সমস্যা সমাধানে পারস্পরিক বোঝাপড়া, আন্তরিক সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক চেষ্টার মাধ্যমে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তবে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রযুক্তির উন্নতির ফলে নতুন যুগে দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান হতে পারে, যদি তারা দীর্ঘমেয়াদী একটি সমঝোতা ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে।