বৃষ্টিতে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এর ফলে নগরবাসীর মনে দানা বেঁধেছে পুরোনো আতঙ্ক— এবারও কি জলাবদ্ধতার কবলে পড়বে ঢাকা? সাধারণ মানুষের প্রশ্ন— এভাবে আর চলবে কতদিন?
মিরপুর, মতিঝিল, আরামবাগ, রাজারবাগ, মগবাজার, মৌচাকের কিছু এলাকায় হাঁটুসমান পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। হাতিরঝিলের কিছু এলাকাতেও পানি জমে আছে। সড়কে জমে থাকা পানির কারণে অনেক এলাকাতে যানজটও তৈরি হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টি হলেই রাজধানীর অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়কগুলো জলাবদ্ধতায় অচল হয়ে পড়ে। দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা রীতিমতো বিপর্যস্ত করে দেয় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। অথচ প্রতি বছরই জলাবদ্ধতা নিরসনে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ, হাতে নেওয়া হচ্ছে প্রকল্পের পর প্রকল্প— কিন্তু দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরেই ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন জলাবদ্ধতা মোকাবিলায় ব্যয় করেছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) বরাদ্দ রেখেছিল ৯০ কোটি টাকা সরাসরি জলাবদ্ধতা নিরসনে, ৩০ কোটি টাকা খাল ও ড্রেন পরিষ্কারে, দুই কোটি টাকায় খাল-পুকুর উদ্ধার এবং এক কোটি টাকায় পানির পাম্প স্থাপন ও ক্রয়ে।

অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) পাম্প হাউস উন্নয়ন ও যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নে ব্যয় করে ২৫ কোটি টাকা, খাল উন্নয়ন ও বৃক্ষরোপণে ৩৮ কোটি টাকা, ড্রেন-খাল রক্ষণাবেক্ষণে আরো প্রায় ৩৯ কোটি টাকা।
বলা চলে, কোটি কোটি টাকা খরচ করেও রাজধানীতে জলাবদ্ধতার দৃশ্যপট বদলায়নি। রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্বে আগে ছিল ঢাকা ওয়াসা। ২০২০ সালের শেষে সব খাল ও নালার দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয় দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে। এরপর থেকেই এই দায়িত্ব এখন সরাসরি কর্পোরেশনগুলোর ওপর বর্তায়। কিন্তু এখনও কার্যকর কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান নয়।
দখল ও বর্জ্যেই বিপর্যস্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা-
কয়েক মাস আগে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে শুধু প্রকল্প গ্রহণ নয় বরং সুনির্দিষ্ট স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করাই জরুরি। অন্যদের ওপর দোষ চাপিয়ে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই সিটি কর্পোরেশনের।
ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর পানি তিনটি মাধ্যমে আশপাশের নদীতে গিয়ে পড়ে— পাম্প স্টেশন, স্লুইসগেট ও খাল। কিন্তু বহু পাম্প স্টেশন ও স্লুইসগেট বর্তমানে অকেজো। খালগুলোও দখল ও বর্জ্যে বিপর্যস্ত। প্রতিদিন সাত হাজার টন বর্জ্যের মধ্যে অন্তত ১৫ শতাংশ প্লাস্টিক ড্রেন ও খাল আটকে দিচ্ছে।
জলাবদ্ধতার হটস্পট— পরিচিত চিত্র-
প্রতি বছর নির্দিষ্ট কিছু এলাকাকে ‘জলাবদ্ধতা হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করছে দুই সিটি কর্পোরেশন। ঢাকা উত্তর অংশে উত্তরখান, দক্ষিণখান, হরিরামপুর, বাড্ডা, ভাটারা, বিমানবন্দর সড়ক, বনানী কবরস্থান সড়ক ও রোকেয়া সরণি জলাবদ্ধতায় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। দক্ষিণে রয়েছে নিউ মার্কেট, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট, মুগদা হাসপাতাল এলাকা, রাজারবাগ ও বকশীবাজার।

‘জেগে উঠুন, দখল ছাড়ুন’— হুঁশিয়ারি প্রশাসকের-
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেছিলেন, “জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে হলে দখলমুক্ত খালই একমাত্র সমাধান। যারা এখনও সরকারি খাল দখল করে ঘুমাচ্ছেন, তাদের ঘুম ভাঙানোর সময় এসেছে।”
তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যে হাইক্কার খাল থেকে অবৈধ ভবন উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং খাল খনন করে লাউতলা খালের সঙ্গে সংযুক্ত করার কাজ চলছে।
জনগণ বলছে, তারা কি তাদের কথার মাঝেই সীমাবদ্ধ? ‘আমরা কথা নয়, বাস্তবায়ন চাই।’
‘ব্লু নেটওয়ার্ক’ গড়ার পরিকল্পনা-
আশার কথা, চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর খাল উন্নয়নে ‘ব্লু নেটওয়ার্ক’ প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। এতে কয়েকটি খাল খনন হয়েছে, আরও কয়েকটি খাল পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা রয়েছে। কাজ শেষ হলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে আশা করছে সিটি কর্পোরেশন।
বাসিন্দাদের ক্ষোভ ও হতাশা-
তবুও নগরবাসীর মনে ক্ষোভ বাড়ছে। ধানমন্ডি এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, “প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ হয় কিন্তু আমাদের ভোগান্তি কমে না। এবারও ভয় পাচ্ছি, ডুববে ঢাকা।”
সরজমিনে দেখা যায়, নিউ মার্কেট এলাকা পুরো ডুবে গেছে। বিভিন্ন যানবাহন পানি ঠেলে পার হচ্ছে, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা জলাবদ্ধতায় ভিজে তাদের বিদ্যাপীঠে যাচ্ছে, অনেকে আবার বাসায় ফিরে যাচ্ছে। কর্মজীবী মানুষ জীবিকার তাগিদে ভিজে হলেও তাদের কর্মস্থলে যাচ্ছে।

নিউ মার্কেট এলাকার একজন দোকানি জানান, “বৃষ্টিতে দোকানে পানি ঢুকলে লাখ টাকার ক্ষতি হয়। বছর বছর অভিযোগ করলেও কাজের কাজ হয় না।”
নিউ মার্কেটের সামনে এক ড্রাইভার বলেন, ক্ষমতায় যেই বসে সেই জনগণকে ভুলে যায়। তারা জনগণের কথা ভাবছেই না, রাজনৈতিক দল নিয়েই তাদের সমস্ত ভাবনা।
ঢাকায় থাকা ১২ বছরের অভিজ্ঞ একজন ড্রাইভার বলেন, “জলাবদ্ধতার কারণে কতবার গাড়ি ঠেলে নিয়ে যেতে হয়েছে, তার হিসেব নেই। এবার অন্তত কিছু একটা হবে আশা করেছিলাম কিন্তু আমরা হতাশ।”
জলাবদ্ধতা ঢাকার চিরচেনা সমস্যা। পরিকল্পনা ও অর্থ ব্যয়ের পরও দৃশ্যমান উন্নতি নেই। একটু বৃষ্টিতেই শহর হাঁসফাঁস করছে, নাগরিকদের মনে প্রশ্ন— জনগণের দিকে দায়িত্ববানদের নজর কি কখনও পড়বে না, দেশে জনগণকে ভুলে যাবার নীতি শেষ হবে কবে?
- প্রতিবেদক: এফ.আর. ইমরান; নিউজ ইডিটর, সিটিজেনস ভয়েস।

