রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে ভয়াবহ খুনের ঘটনায় নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এগারো মাস পেরিয়ে গেলেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থতার অভিযোগ সামনে এসেছে বারবার।
মব সহিংসতা বাড়ছেই
দেশজুড়ে মব হামলা, খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক সহিংসতার মতো অপরাধ বেড়েই চলেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে এসব নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
বিএনপি ও সংশ্লিষ্ট দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে মবকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন, সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া মব সহিংসতা এমন বিস্তার লাভ করতে পারে কি না।
খুলনায় যুবদল নেতাকে খুন করে রগ কেটে দেওয়া, চাঁদপুরে মসজিদে ইমামকে কুপিয়ে হত্যা, মাদারীপুরে মসজিদের ভেতর আপন দুই ভাইসহ তিনজনকে হত্যা—এসব ঘটনা সারা দেশে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, গত ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৪১টি মব হামলায় প্রাণ গেছে ৮৩ জনের। এর মধ্যে ঢাকায়ই মারা গেছে ৪৫ জন।
ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৩০টি, যার মধ্যে ৬৬টি ছিলো দলবদ্ধ ধর্ষণ। ২২টি ঘটনায় ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছে ভুক্তভোগীদের।
এছাড়া গণপিটুনিতে ৮৯ জন, রাজনৈতিক সহিংসতায় ৪৪ জন, নিরাপত্তা হেফাজতে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যায় ১৫ জন নিহত হয়েছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, অপরাধ দমনে রোববার থেকেই ‘চিরুনি অভিযান’ শুরু হয়েছে। তিনি জানান খুন, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, মাদকসহ সকল অপরাধ দমনে সরকার কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে।
এদিকে সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দাবি করেন, মব জাস্টিসে জড়িতদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হয়নি এবং সরকারের কোনো সংযুক্তি নেই।
বিএনপি অভিযোগ করছে, সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়ন্ত্রণহীন রেখেছে, যেন নির্বাচনী সময় বিলম্ব হয়। ছাত্রদল ও যুবদলের পক্ষ থেকেও একই অভিযোগ এসেছে। তারা বলছে, একটি গোপন গোষ্ঠী মব তৈরি করে বিশৃঙ্খলা ছড়াচ্ছে।
অন্যদিকে জামায়াতসহ আরও কিছু দল এই বিশৃঙ্খলার জন্য বিএনপিকেই দায়ী করছে।
বিশ্লেষকরা কী বলছেন?
সাবেক আইজিপি এম নূরুল হুদা মনে করেন, সরকারের পক্ষ থেকে শুরু থেকেই মারাত্মক শৈথিল্য ছিল। তিনি বলেন, “সঠিক সময়ে ব্যবস্থা না নেওয়ায় অনেকেই মনে করছে, অন্যায় করেও তারা শাস্তি পাবে না।”
মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন বলেন, “মব তৈরি করে খুন, দখল, চাঁদাবাজি—সব কিছুই চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কড়া পদক্ষেপ না নিলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।”
তিনি মনে করেন একদিকে শাসনের ঘাটতি, অন্যদিকে অপরাধের রাজনৈতিক রং দেওয়া—এই দুইয়ের ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্যমতে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে শুধুমাত্র রাজনৈতিক সহিংসতায় উল্লেখযোগ্য প্রাণহানির পাশাপাশি চাঁদাবাজি, নারী ও শিশু নির্যাতন, সাংবাদিক নিপীড়ন, সংখ্যালঘু হামলা এবং সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়ার মতো ঘটনাও বাড়ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রবণতা রোধে শুধু আইন প্রয়োগ নয় বরং সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সম্মিলিত প্রতিরোধ প্রয়োজন।

