যাত্রী হারানোর ও আর্থিক ক্ষতি বৃদ্ধি শঙ্কা—
বিমানের ডানা মেলায় এক বছরের বেশি সময়েও অব্যবস্থাপনার জটিলতায় মুক্তি পায়নি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বিগত সরকার পতনের পর নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ বিভিন্ন পদে নতুন মুখ নিয়োগ দেওয়া হলেও প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ জটিলতা ও অব্যবস্থাপনা দূর করতে পারেনি। উল্টো একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটি, ফ্লাইট শিডিউল বিঘ্ন, রুট বন্ধ ও অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটাসহ নানা সমস্যা জটিলতা আরো বাড়িয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক ক্ষতি বেড়েছে, সঙ্গে যাত্রী সংখ্যা কমে যাওয়ার শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। বিমান সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিভিন্ন উদ্যোগ থাকলেও ‘অদৃশ্য সিন্ডিকেট’ ও অব্যবস্থাপনা নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছে। সিন্ডিকেটের কিছু পক্ষ আগের মতোই বিমান পরিচালনায় নিজেদের প্রভাব বজায় রাখছে। অনেকে অভিযোগ করেন, কর্মীদের মধ্যে অনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন চোরাচালান ও নারী কর্মীদের প্রতি নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে, অথচ এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
বিমানের অভ্যন্তরীণ অবস্থা, দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের স্থবিরতা: বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে বহু কর্মকর্তাই বিগত সরকারের আমলে নিয়োগ পেয়েছিলেন এবং এখনও গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। বিশেষ করে প্রকৌশল ও ম্যানেজমেন্ট বিভাগে তারা জেঁকে বসে আছেন, যা নতুন ম্যানেজমেন্টকে কাজ করতে বাধা সৃষ্টি করছে। এমনকি কেউ কেউ অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির মাধ্যমে ম্যানেজমেন্টের কাজকর্মে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার সম্ভাবনার কথাও উঠেছে।
প্রকৌশল বিভাগের গাফিলতি, যান্ত্রিক ত্রুটিতে বাড়ছে সমস্যা: বিমান বহরে বর্তমানে ১৯টি বিমান রয়েছে— যেখানে বোয়িং ৭৭৭, বোয়িং ৭৮৭, বোয়িং ৭৩৭ এবং ড্যাশ ৮-৪০০ মডেলের বিমান অন্তর্ভুক্ত। সূত্র মতে, অধিকাংশ উড়োজাহাজে নিয়মিত যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ছে। এমনকি আধুনিক ড্রিমলাইনার বিমানে এমন সমস্যা বেড়ে যাওয়া বিমানের ফ্লাইট পরিচালনায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাত্রীদের ভোগান্তিও ঘটছে, ফলে বিমানের যাত্রী সংখ্যা কমছে।
প্রকৌশল বিভাগের একাংশের কর্মকর্তারা নিজ দায়িত্বে অবহেলা করছেন বলেও অভিযোগ আছে। যন্ত্রাংশ কেনাকাটার সময় তারা কমিশন পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন ও বিদেশ ভ্রমণের সুবিধা নিচ্ছেন।
গত এক মাসে অন্তত ১৬ বার যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়েছে, যার মধ্যে মাঝ আকাশে বিমানের টয়লেট খারাপ হওয়া, ইঞ্জিন কম্পন, কেবিন প্রেশারের ত্রুটি, লাগেজ ট্রলির আঘাত ইত্যাদি রয়েছে। এসব কারণে ফ্লাইট সময়মতো শুরু হচ্ছে না, যাত্রীদের বড় ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বহরে যান্ত্রিক ত্রুটির পাশাপাশি বিমান সংকটের কারণেও ফ্লাইট শিডিউল বিশৃঙ্খল হচ্ছে।
প্রধান কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি ও ফ্লাইট বিঘ্নের উদাহরণ:
- ৩১ জুলাই: শারজাহ বিমানবন্দরে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বোয়িং ৭৩৭ আট ঘণ্টা আটকে থাকে।
- ২৮ জুলাই: দাম্মামগামী বিমানে কেবিন প্রেশারে ত্রুটি ধরা পড়ে।
- ২৪ জুলাই: দুবাই থেকে চট্টগ্রামে আসা ড্রিমলাইনার বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়।
- ১৬ জুলাই: দুবাই-ঢাকা রুটের বোয়িং ৭৮৭-৯ উড়োজাহাজ ‘গ্রাউন্ডেড’ হয়।
- ৫ জুলাই: ব্যাংককগামী বিমানের ফ্লাইট বাতিল হয় ত্রুটির কারণে।
- ১ জুলাই: হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে লাগেজ ট্রলির আঘাতে বোয়িং ৭৩৭-এর বডি ফুটো হয়।
- ২৭ জুন: ঢাকা-থাইল্যান্ড ফ্লাইট ৫ ঘণ্টা বিলম্বিত হয় ত্রুটির কারণে।
- ১৬ মে: কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইটে চাকা খুলে পড়ে।
প্রকৌশল ও কোয়ালিটি কন্ট্রোল বিভাগে ত্রুটির দায়-দায়িত্ব: বিমান সূত্র জানায়, প্রকৌশলীরা উড়োজাহাজ পরীক্ষা করেন কিন্তু কোয়ালিটি এসুরেন্স বিভাগের পর্যবেক্ষণ না থাকায় ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। চিফ ইঞ্জিনিয়ার আর এম কায়সার জামান বর্তমানে হাঙ্গেরিতে অবস্থান করছেন যেখানে তিনি কিছু মেরামতির কাজ করছেন। এর আগে তিনি বিমানের ড্যাশ-৮ কেনার জন্য কানাডা গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে যুক্ত একদল ইঞ্জিনিয়ার বর্তমানে হাঙ্গেরিতে রয়েছেন।
অপ্রয়োজনীয় সফটওয়্যার কেনাকাটায় কোটি কোটি টাকা অপচয়: বিমানের অর্থ পরিদপ্তরের পরিচালক নওসাদ হোসেনের নেতৃত্বে ৪ কোটি টাকার একটি ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সফটওয়্যার (এমআইএস) কেনা হয়েছে, যা ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সাথে খুব কম সম্পৃক্ত একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চুক্তি করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সেন্ট্রাল পারচেজিং কমিটির মতামত উপেক্ষিত হয়েছে। অর্থ ও হিসাব বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মিজানুর রশিদ বিষয়টি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করেছেন।
অর্থ বিভাগের আরো অভিযোগ রয়েছে, নওসাদ হোসেন আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে ৫ লাখ ডলার পাঠানোর সময় ভুল তথ্য দিলে টাকা ভুল ইনভয়েসে চলে যায়। এটি দীর্ঘ সময় জমা হয়নি এবং বিষয়টি চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বিমানের ফান্ড নিজ নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রয়োজনীয় অনুমোদন ছাড়া কম সুদে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকে আমানত রাখার তথ্যও পাওয়া গেছে। এর ফলে ফারমার্স ব্যাংকে ১০ কোটি টাকা আমানত গচ্ছিত হয়েছে।
যাত্রী সংকট ও লাভজনক রুট বন্ধ: ঢাকা-নারিতা সরাসরি ফ্লাইট চালু হলেও যাত্রী সংকট ও লোকসানের কারণে রুটটি ১ জুলাই থেকে বন্ধ হয়ে গেছে। এই ফ্লাইটের জন্য যথাযথ প্রচার না করায় যাত্রী কমে গেছে বলে বিমান কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে জানা গেছে। ঢাকা-রোম রুটেও গাফিলতির কারণে যাত্রী সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। কাঁচা ও পচা খাবার নিয়ে যাত্রীরা বিমানে উঠছেন যা রোমে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে এবং বিমানকর্মীদের সেবা মান প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। রোমের বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এই ঘটনাকে দেখে ফ্লাইট ছাড়ার অনুমতি দেরিতে দিয়েছে।
কর্মস্থলে নারী কর্মীদের প্রতি নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ: ২০২৪ সালের ১ মে ঢাকা-দুবাই ফ্লাইটে দায়িত্বরত অবস্থায় নারী সহকর্মী চিফ পার্সার আবদুর রহমান সুমনের হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হন বলে অভিযোগ ওঠে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আরো নারী কর্মীও একই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, কিন্তু শাস্তির ব্যবস্থা নেই।
চোরাচালান, ধূমপান ও অন্যান্য অনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত: বিমান কর্মীদের মধ্যে চোরাচালান ও অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ বহুদিন ধরেই রয়েছে, যা বন্ধ হচ্ছে না। ২০২৪ সালের আগস্টে দুই কেবিন ক্রু মোবাইল ফোন ও স্বর্ণ চোরাচালান করে ধরা পড়েছেন। এছাড়া ইউনিফর্মে ধূমপানের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বিমান কর্মীরা ধূমপান করছেন, যা সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও হয়ে ভাইরাল হয়েছে। এর বিরুদ্ধে তত্পর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বিমানের প্রতিক্রিয়া ও অবস্থা: বিমানের মুখপাত্র আল মাসুদ খান জানান, সব উড়োজাহাজকে সার্টিফায়েড ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা যাচাইয়ের পর উড্ডয়ন অনুমোদন দেওয়া হয়। যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়লে তা দ্রুত মেরামত করা হয় এবং যাত্রী নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। তবে সাম্প্রতিক ছোটখাটো ত্রুটির কারণে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। যেকোনো সমস্যা আইন ও বিধি অনুসারে দ্রুত সমাধান করা হয়। তবুও যেকোনো ব্যত্যয় থাকলে কর্তৃপক্ষ আন্তরিকভাবে তা মেটানোর চেষ্টা করে।

