গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশের রাজপথে এক ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল। মূল প্রেরণা ছিল বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের তীব্র সংকট। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। তখনই তরুণ প্রজন্ম আশাবাদী হয়ে উঠেছিল—সরকার বদল মানে হয়তো কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি। কিন্তু এক বছর পার হয়ে গেলেও সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রূপ নেয়নি।
সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তি আগের মতোই সীমিত। ফলে হাজারো স্নাতক ডিগ্রিধারীকে অল্প কিছু পদে চরম প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে। একই সময়ে শিল্পখাতও স্থবির। ব্যাংক ঋণ বিতরণ ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিসংখ্যান বলছে—গত এক বছরে নতুন কারখানা চালুর কোনো গতি দেখা যায়নি। বরং অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান টিকে থাকার জন্যই লড়াই করছে। উৎপাদন সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে।

বাংলাদেশি কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক কর্মসংস্থান থেকে দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছেন। কিন্তু ২০২৪ সালে আগের বছরের তুলনায় বিদেশে চাকরির সুযোগ প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) জানায়, এ বছর বিদেশে গেছেন প্রায় ১০ লাখ মানুষ, যা ২০২৩ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। শুধু গত বছরের মে মাস পর্যন্তই বিদেশে কাজ করতে গেছেন চার লাখের বেশি মানুষ—তুলনামূলকভাবে ধীরগতি।
সীমিত অর্থায়নের কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আগেই সংকটে ছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে কিন্তু বিক্রি কমেছে। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) খাতের সম্প্রসারণ থমকে গেছে। নতুন বিনিয়োগ না হওয়ায় চাকরির নতুন সুযোগও তৈরি হচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এবং দুই অঙ্কের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কড়াকড়ি আর্থিক নীতি গ্রহণ করে, যাতে ঋণ পাওয়া ব্যয়বহুল হয়ে যায়। এই নীতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সহায়তা করলেও বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম কয়েক মাসে আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করেছে। অনেক উদ্যোক্তা নতুন প্রকল্প হাতে নেননি। দেশের বেসরকারি বিনিয়োগের নিম্নগতি ব্যাংক ঋণ প্রবৃদ্ধি ও আমদানি তথ্যেও স্পষ্ট—মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি কমেছে, যা ভবিষ্যতের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাসের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
কর্মসংস্থান সংকট শুধু চাকরির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে নয়—দক্ষতার অসামঞ্জস্যও বড় কারণ। সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন- শিক্ষার্থীরা যা শিখছে এবং শ্রমবাজারে যা প্রয়োজন, তার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। গত এক বছরে শিক্ষাখাত সংস্কারের কোনো বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
তিনি আরও বলেন- জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম মূল ইস্যু ছিল কর্মসংস্থান। কিন্তু এক বছরে সরকার কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাতে পারেনি। এমনকি সানেমের জরিপ অনুযায়ী, ৫০ শতাংশের বেশি চাকরিপ্রার্থী গত এক বছরে সাক্ষাৎকারের ডাকও পাননি।
সরকার আগামী তিন বছরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ খাতে ১৫ হাজার নতুন উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে (সিএমএসএমই) ১০ হাজার উদ্যোক্তাকে এক হাজার কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে। বাজেটে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের জন্য যুবঋণের সীমা দুই লাখ এবং সফল উদ্যোক্তাদের জন্য পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ২০২৮ সালের মধ্যে নয় লাখ তরুণকে প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। বর্তমানে ৪৮ জেলায় ২৮ হাজার ৮০০ শিক্ষিত বেকার ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন।
২০২৪ সালের মে মাসে ইতিবাচক খবর আসে জাপান থেকে। দেশটি আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে অন্তত এক লাখ দক্ষ কর্মী নেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া, শ্রম অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিতে সরকার সাইদ সুলতান উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, যা নিয়োগকর্তাদের চাহিদা বোঝার জন্য আলাদা গবেষণা বিভাগ গঠনের সুপারিশ করেছে।
কমিশন প্রধানের মতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ—সরকারি সংস্থা, দক্ষতা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান, শিল্প সমিতি, একাডেমিক প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে সমন্বয় জরুরি। কিন্তু বর্তমানে এ ধরনের সহযোগিতা কার্যত অনুপস্থিত।
শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনও স্বীকার করেছেন, শ্রম মন্ত্রণালয়ে এখনো কর্মসংস্থান শাখা নেই। সেটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তার মেয়াদে শেষ নাও হতে পারে।
চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা সংস্কারের প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি দীর্ঘমেয়াদি কাজ এবং পরবর্তী সরকারের উদ্যোগ প্রয়োজন।

