বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। আন্দোলনের অগ্নিস্ফূলিঙ্গ হয়ে ওঠে সত্যজিৎ রায়ের কালজয়ী চলচ্চিত্র হীরক রাজার দেশের এক সংলাপ—“দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান-খান”। চলচ্চিত্রের কাহিনিতে এই লাইন ছিল কর্তৃত্ববাদী শাসকের পতনের প্রতীক। মুক্তির পর থেকেই এটি শুধু সাংস্কৃতিক উপাদান নয় বরং রাজনৈতিক সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
বছরের পর বছর রাজনৈতিক কর্মী, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও নাগরিক আন্দোলন এই স্লোগানকে ব্যবহার করেছে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। দেয়ালচিত্র, পোস্টার, ব্যানার, কার্টুন—সব মাধ্যমেই এর উপস্থিতি ছিল স্পষ্ট। তবে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে এই লাইন যেন সিনেমা থেকে বেরিয়ে বাস্তবের রাজনীতিতে অবতীর্ণ হয় এবং ইতিহাসের অংশে পরিণত হয়।
শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের শাসনকাল, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমন এবং ধারাবাহিকভাবে বিনা ভোটে ক্ষমতায় থাকার সংস্কৃতি অভ্যুত্থানের দিন দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন শহর ও জনপদে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়, নেতাকর্মীদের অফিস এবং সরকার-সম্পর্কিত প্রতীকী স্থাপনা জনতার আক্রমণের মুখে পড়ে। এর মধ্যে সংসদ ভবনও ছিল, যা অনেকে মনে করতেন কার্যত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতীক ও চিহ্নের গুরুত্ব গভীর। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক ‘নৌকা’ শুধুমাত্র একটি দলীয় প্রতীক নয়; বরং এটি শেখ মুজিবুর রহমানের নাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং দলটির রাজনৈতিক পরিচয়ের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে গেছে।
বছরের পর বছর ধরে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে, যাতে মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ কেবল তাদেরই অর্জন। এই বয়ানের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির অবদান প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় প্রচার, শিক্ষা, গণমাধ্যম এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই সমার্থকতা প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে প্রোথিত হয়।
ফলে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যেকোনো স্মারক বা ভাস্কর্যকেও সাধারণ মানুষ প্রায়ই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে পড়তে শুরু করে। এ কারণেই জুলাই অভ্যুত্থানের সময় মুক্তিযুদ্ধের স্মারকও কখনো কখনো ক্ষোভের শিকার হয়েছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে রাষ্ট্রীয় অর্থে অসংখ্য ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে তৈরি স্থাপনা, বিশেষ করে ‘জাতির পিতা’র ভাস্কর্য নামে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে এই উপাধি যুক্ত হওয়ার পর ভাস্কর্য নির্মাণের গতি আরো বেড়ে যায়।
তবে এসব স্থাপনার নান্দনিক মান ও শিল্পগুণ নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনা ছিল। অনেক শিল্পী ও স্থপতি অভিযোগ করেন, তড়িঘড়ি করে নির্মাণ, মানসম্মত নকশার অভাব এবং অদক্ষ কারিগরি কাজের কারণে এগুলোর মান প্রশ্নবিদ্ধ। পাশাপাশি নামকরণেও রাজনৈতিক পক্ষপাত ছিল স্পষ্ট—শেখ পরিবারের নাম বা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থাকলেই যেন অগ্রাধিকার দেওয়া হতো।
ফলে এগুলো কেবল ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক স্মারক নয় বরং দলীয় রাজনীতির দৃশ্যমান প্রতীক হিসেবে জনমনে স্থান করে নেয়।
অভ্যুত্থানের সময় ও পরবর্তী কয়েকদিনে সারা দেশে প্রতীক ধ্বংসের ঢল নামে। ফ্যাসিবাদের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত বহু স্থাপনা, ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ভেঙে ফেলা হয় বা নাম পরিবর্তন করা হয়। এর মধ্যে অনেকই ছিল সরাসরি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত, আবার অনেকগুলো ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ববাহী হলেও ক্ষোভের নিশানায় পড়েছিল।
গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- ময়মনসিংহের শশী লজের ‘ভেনাস’ ভাস্কর্য — যা ছিল স্থানীয় ঐতিহ্যের অংশ, তবে ‘ক্ষমতার প্রতীক’ হিসেবে চিহ্নিত করে ভেঙে ফেলা হয়।
- জয়দেবপুরের ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ — মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনী প্রতিরোধের স্মারক কিন্তু তাও রক্ষা পায়নি।
- শিশু একাডেমীর ‘দুরন্ত’ ভাস্কর্য — শিশু-কিশোর সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবেও ছিল এর পরিচিতি।
- পলাশীর ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ চত্বর — ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন।
- সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মারক সিধু-কানুর ভাস্কর্য — ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রতীক।
- বেগম রোকেয়া ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠান — যেগুলোর নামও পাল্টে ফেলা হয়।
এসব ধ্বংসযজ্ঞ কেবল দলীয় প্রতীক মুছে ফেলার প্রচেষ্টা নয় বরং ইতিহাস ও প্রতিরোধের চেতনার ওপর আঘাত হিসেবে দেখা শুরু হয়।
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় ভাঙচুর ও নাম পরিবর্তনের পেছনে জনতার ক্ষোভ স্পষ্ট। দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসনের স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংসের মাধ্যমে অনেকেই মনে করেন, তারা অবিচার ও দমন থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন। এই দৃষ্টিতে কিছু স্থাপনা ভাঙা বা নাম পরিবর্তন যৌক্তিক বলেই গণ্য হতে পারে।
তবে বিষয়টি একেবারেই সরল নয়। বহু স্মারক ছিল জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ, যা রাজনৈতিক দল বা কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত ছিল না। যেমন সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মারক সিধু-কানু, মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক স্মৃতি, ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক ভাস্কর্য ও ম্যুরাল। এসব ধ্বংসের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা বিভ্রান্তি থাকতে পারে বলে অনেকের মত।
জনমতও বিভক্ত। একদিকে অনেকেই মনে করেন, ফ্যাসিবাদের অবসানে এসব ধ্বংস প্রয়োজন ছিল। অন্যদিকে অনেকে এই কর্মকাণ্ডকে ইতিহাসের অপমান ও জাতীয় ঐতিহ্যের অবক্ষয় হিসেবে দেখেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি স্মারক ধ্বংসের আগে তার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব সঠিকভাবে যাচাই করা জরুরি।
অভ্যুত্থানের প্রথম দফায় এসব স্মারক ধ্বংসকে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হলেও, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একই ঘটনা অব্যাহত থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো নীতিমালা বা বক্তব্য না আসায় প্রশ্ন দেখা দেয়—এই ধ্বংসযজ্ঞ কি অনুমোদিত?
সরকারের নীরবতা অনেকের কাছে ক্ষমতার নিস্প্রভতা ও অক্ষমতার দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরা হয়। সরকারের সদিচ্ছা ও সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ জাগে। এতে দেশের সামাজিক ঐক্য, ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্নের রক্ষা ও সামগ্রিক গ্রহণযোগ্যতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
রাজনৈতিক মহল এবং বুদ্ধিজীবীরা সরকারের দ্রুত কার্যকর ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন, যাতে ধ্বংসযজ্ঞ থামে এবং জাতীয় ঐতিহ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস বহুস্তরীয়। মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি রাজনৈতিক যুদ্ধ নয়, এটি ছিল জাতীয় অস্তিত্ব ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম। একই সঙ্গে পূর্ববর্তী সাঁওতাল বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলন ও ঔপনিবেশিক বিরোধী সংগ্রামও দেশের প্রতিরোধের ধারাবাহিক অংশ।
জুলাই অভ্যুত্থান এই ধারাবাহিকতায় নতুন অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অনেক অংশগ্রহণকারী এটিকে মুক্তিযুদ্ধের অব্যাহত প্রতিরোধ মনে করেন। তাই ঐতিহাসিক স্মারক ও প্রতিরোধের প্রতীক ধ্বংস তাদের কাছে মানসিক আঘাত।
এ কারণে ঐতিহাসিক স্মৃতি ও প্রতীক রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ও প্রতিরোধের ইতিহাস সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলে, চলমান ধ্বংসযজ্ঞের ফলে জাতীয় ঐতিহ্য বিপন্ন হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি স্পষ্ট ও কার্যকর পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ জরুরি। কোন স্মারক ফ্যাসিবাদের চিহ্ন, আর কোনটি জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ—সেটি নির্ধারণ করতে হবে যথাযথ সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে।
পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝি ও অনাকাঙ্ক্ষিত ধ্বংস প্রতিরোধ করা যাবে। দেশের সামাজিক ঐক্য বজায় রাখতে ও ইতিহাসের সঠিক চিত্র সংরক্ষণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সরকারের দায়িত্ব হবে স্পষ্ট নীতি ঘোষণা করে জনগণের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির অংশগ্রহণ জরুরি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই বহু দশক ধরে চলে আসছে। হীরক রাজার দেশের “দড়ি ধরে মারো টান” লাইন যেমন একনায়কতন্ত্রের পতনের প্রতীক, তেমনি দেশের নতুন যুগের সূচনা। কিন্তু এই সূচনাকে শক্তিশালী করতে হবে ঐতিহাসিক স্মৃতির সঠিক সংরক্ষণ ও সম্মানের মাধ্যমে।
ফ্যাসিবাদের চিহ্ন মুছে ফেলার নাম করে জাতীয় ঐতিহ্যের ক্ষয়ক্ষতি দেশকে বিভাজনের পথে নিয়ে যেতে পারে। তাই স্মারক ধ্বংসের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পুনর্মূল্যায়ন প্রক্রিয়া জরুরি।
জনগণের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে কিন্তু সেই সাথে জাতীয় ইতিহাসের সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশ হবে শক্তিশালী ও ঐতিহ্যময় নতুন রাষ্ট্র।

