নির্বাচনের পর যেই সরকারই ক্ষমতায় আসুক, তাদের সামনে রয়েছে জটিল ও বহুস্তরীয় চ্যালেঞ্জ। উন্নয়ন অগ্রগতির জন্য শুধু বড় পরিকল্পনা বা বাজেটই যথেষ্ট নয়। সরকারের দক্ষতা এবং পরিচালন ক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষতা বলতে বোঝায় সরকারের অপারেটিং খরচ কমিয়ে কাজের গুণগত মান বাড়ানো। আর এটা না হলে, দেশের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে, জনগণের আস্থা কমে এবং সেবা দিতে ব্যর্থ হয়। তাই এখন থেকেই ‘দক্ষ সরকার’ গড়ার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
সরকারের অপারেটিং কস্ট বা প্রশাসনিক ব্যয় বিশাল। এতে কর্মচারী বেতন, প্রশাসনিক খরচ, প্রকল্প বাস্তবায়নের খরচ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। যখন ট্যাক্সদাতারা এই ব্যয় বহন করে, তখন সরকারের উচিত এসব খরচ কমিয়ে সেবা উন্নত করা। দক্ষ সরকার মানে সরকারি খরচে সাশ্রয় কিন্তু জনগণের জন্য সেবা বাড়ানো।
‘সরকারকে ছোট করা’ শোনার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই ভাবেন এটি সরকারের ক্ষমতা কমানো বা দুর্বল করা। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। ছোট সরকার মানে সরকার শুধুমাত্র তার মূল ও অপরিহার্য কাজগুলোই করবে। অন্য কথায়, সরকার অপ্রয়োজনীয়, জটিল ও ব্যয়বহুল কার্যক্রম থেকে দূরে থাকবে। এতে সরকারের কাজের গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে, জনগণের ট্যাক্স কম লাগবে, আর সেবা সহজ ও কার্যকর হবে।
সরকার যখন সবকিছু নিজে করার চেষ্টা করে, তখন খরচ বাড়ে এবং কাজের মান পড়ে। ছোট সরকার হলে সরকার তার সীমা জেনে কাজ করবে। সে শুধু নীতি নির্ধারণ করবে, আইন প্রণয়ন করবে এবং সেবার মান নিরীক্ষণ করবে। বাস্তবায়ন এবং অন্যান্য কার্যক্রম বেসরকারি ও সিভিল সোসাইটির হাতে থাকবে।
সরকারের অপারেটিং কস্ট বলতে বোঝায় প্রশাসনিক ও পরিচালন ব্যয় যা সরকারি কার্যক্রম চালাতে লাগে। এতে অন্তর্ভুক্ত আছে:
- কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা
- অফিস রক্ষণাবেক্ষণ ও বিল (বিদ্যুৎ, পানি, ইন্টারনেট)
- সরকারি যানবাহন ও যাতায়াত খরচ
- প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়মিত খরচ
- আইটি ও কম্পিউটারাইজেশনের ব্যয়
বিশ্বব্যাপী গবেষণায় দেখা গেছে, সরকারি অপারেটিং কস্টের উচ্চতা সরকারের কার্যক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। অপচয় রোধ করতে না পারলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যেটা জনগণের ওপর অতিরিক্ত ট্যাক্স বোঝার মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
বাংলাদেশেও সরকারি খরচের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না হলে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই অপারেটিং কস্ট নিয়ন্ত্রণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারের সেবা উন্নত করা খুব জরুরি।
একটি দেশের সরকার সীমিত ক্ষমতা নিয়ে কাজ করে। কিন্তু অনেক সময় সরকার চেষ্টা করে সবকিছু নিজের হাতে নিতে—রেলওয়ে চালানো, ব্যাংক খোলা, দোকান পরিচালনা, মোবাইল অ্যাপ তৈরি, বীমা সেবা দেওয়া, রাস্তার পাশে গাছ লাগানো ইত্যাদি। এ ধরনের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণের ফলাফল সবসময় ভাল হয় না।
সরকার যখন বিচারক, খেলোয়াড় এবং রেফারি একসঙ্গে হয়ে যায়, তখন ন্যায্য প্রতিযোগিতা নষ্ট হয়। প্রাইভেট সেক্টরের উদ্যোগ হারিয়ে যায় এবং বাজারের গতিশীলতা কমে যায়। ফলে সেবা দুর্বল হয়, জনগণের আস্থা কমে এবং ট্যাক্সের অর্থ অপচয় হয়।
অর্থনীতির পরিভাষায় এ সমস্যাকে ‘সরকারি ব্যর্থতা’ (Government Failure) বলা হয়। যেখানে সরকার তার সীমা না জানায় এবং অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় ও সম্পদ ব্যয় করে। এ থেকে বাঁচার জন্য সরকারকে তার মূল কাজেই মনোযোগ দিতে হয়—নীতি ও নিয়ম প্রণয়ন, সেবা নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা।
সরকার যদি কৃষকদের জন্য মোবাইল অ্যাপ তৈরি করে কিন্তু সেটি সঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে জনগণ হতাশ হয়। ইউজার ইন্টারফেস যদি জটিল হয়, তথ্য যদি আপডেট না হয় তাহলে সেবা কার্যকর হয় না।
অন্যদিকে, দক্ষ স্টার্টআপ বা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান এ ধরনের প্রযুক্তি কম খরচে ও দ্রুত উন্নত করতে পারে। তারা বাজারের চাহিদা বুঝে দ্রুত সাড়া দেয়, ব্যবহারকারীদের প্রয়োজন অনুসারে ফিচার যুক্ত করে।
এক্ষেত্রে সরকারের কাজ হবে ‘এনাবলার’ হওয়া—নীতিমালা তৈরি, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, নিয়ন্ত্রণ আর গাইডলাইন দেয়া। বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ প্রাইভেট সেক্টরের হাতে থাকলে খরচ কমে, সেবার মান বাড়ে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এটি সরকার ও জনগণের জন্য সর্বোত্তম সমাধান।
বর্তমান বিশ্বে সরকার একা সব কিছু করতে পারে না, বিশেষ করে যখন বাজেট সীমিত। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপি এমন একটি মডেল যা সরকারের জন্য নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে। পিপিপি-র মাধ্যমে সরকার প্রাইভেট সেক্টরের দক্ষতা ও বিনিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে। যেমন রাস্তাঘাট নির্মাণ, পানি সরবরাহ, স্বাস্থ্যসেবা এবং তথ্যপ্রযুক্তি সেবা।
পিপিপি মডেল খরচ কমায়, সেবা দ্রুত দেয় এবং উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাজের মান বাড়ায়। সরকারের বাজেট কম পড়ে, কারণ খরচের একটি বড় অংশ বহির্ভূত বিনিয়োগ থেকে আসে। একই সঙ্গে, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় প্রশাসনিক কাজ বা সাপোর্ট সেবা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া যায়। এতে সরকার তার মূল কাজের ওপর বেশি মনোনিবেশ করতে পারে।
পিপিপি ও আউটসোর্সিংয়ের সফল বাস্তবায়ন দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করে এবং সরকারি খরচে সাশ্রয় আনে।
সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও বিভাগগুলো যদি তাদের কাজ স্পষ্টভাবে ভাগ না করে, তাহলে কাজের পুনরাবৃত্তি, ঝামেলা ও জটিলতা বাড়ে। অনেক সময় একই ধরনের কাজের জন্য একাধিক দপ্তর দায়িত্ব নেয় কিন্তু কারও পূর্ণ দায়িত্ব থাকে না। ফলে দায় এড়ানোর প্রবণতা বেড়ে যায়, সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হয় এবং কর্মদক্ষতা কমে।
সরকারকে উচিত স্পষ্ট লাইন টানা, কার কাজ কী এবং দায়িত্ব কার। এতে কাজের গতি বাড়ে, জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় এবং জনসেবা দ্রুত পৌঁছে। এছাড়াও, দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি পায়, যা নীতি বাস্তবায়নে সাহায্য করে।
এই কাজের জন্য একটি শক্তিশালী মনিটরিং ও ইভ্যালুয়েশন ব্যবস্থা থাকা দরকার, যাতে কোন দপ্তর কতটা কার্যকর এবং জনসেবা কতটুকু পৌঁছাচ্ছে, তা নিয়মিত পর্যালোচনা করা যায়।
ডিজিটাল গভর্ন্যান্স বলতে বোঝায় সরকারের কাজ ও সেবা ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে চালানো। এর মাধ্যমে নাগরিকরা অনলাইনে আবেদন করতে পারে, ফর্ম পূরণ করতে পারে, অভিযোগ জানাতে পারে এবং সরকারি তথ্য পেতে পারে সহজে। এটি অফিসিয়াল কাজ কমিয়ে দেয়, কাজের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করে এবং সময় সাশ্রয় করে।
বিশ্বব্যাপী দেখা গেছে, ডিজিটাল গভর্ন্যান্স সরকারের অপারেটিং কস্ট প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত ও এস্তোনিয়ার মতো দেশ ডিজিটাল গভর্ন্যান্সে সফল হয়ে সেবা প্রাপ্তিতে নাগরিকদের সুবিধা দিয়েছে।
বাংলাদেশেও ডিজিটাল সেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে সরকারি কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। এতে দুর্নীতি কমে, জনগণের আস্থা বাড়ে এবং সরকারি খরচ কমে। ডিজিটালাইজেশন সরকারি সেবা সাশ্রয়ী ও দ্রুত করে তোলে।
ছোট সরকার মানে কাজের অপ্রয়োজনীয়তা কমে, খরচ কমে এবং জনসেবার মান বাড়ে। যখন সরকার নিজের সীমা চিনে, তখন সে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখতে পারে। এর ফলে ট্যাক্সের বোঝা কমে এবং জনগণের আস্থা সরকারে বাড়ে।
ছোট সরকার অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আনে। কম খরচে কার্যকর সেবা দিলে বিনিয়োগ বাড়ে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং দেশ উন্নতির দিকে যায়। এটি রাজস্ব ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করে, দুর্নীতি কমায় এবং সামাজিক উন্নয়নে সহায়ক হয়।
একই সঙ্গে ছোট সরকার সরকারি দায়িত্ব ও কর্মক্ষমতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয় নাগরিকদের। এতে সরকার-জনগণ সম্পর্ক গভীর হয়, যেখানে ট্যাক্স দেওয়াকে মানুষ বাধ্যবাধকতা নয় বরং গর্বের বিষয় মনে করে।
একটি সফল রাষ্ট্র গড়তে হলে ছোট, দক্ষ ও পরিকল্পিত সরকার গড়তে হবে। সরকার যেন তার ক্ষমতার সীমা জানে, দায়িত্ব বুঝে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে। এতে সরকার তার সম্পদ ও ক্ষমতা সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করতে পারে।
সরকার যখন মূল কাজগুলোতে মনোযোগ দেয়, তখন জনগণের আস্থা বেড়ে যায়। সরকারের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন হয়, যা সামাজিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। সরকারের খরচ কমে, সেবা উন্নত হয় এবং দেশের সামগ্রিক চিত্র পরিবর্তিত হয়।
সবশেষে, ছোট ও দক্ষ সরকার গড়া মানে দেশের উন্নয়ন, জনগণের কল্যাণ এবং শক্তিশালী জাতি গঠন। এটাই বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা।

