কক্সবাজার বিমানবন্দর এখন আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য প্রায় প্রস্তুত। কয়েক হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের ফলে রানওয়ে সম্প্রসারণ ও নতুন টার্মিনাল ভবনের কাজ শেষ পর্যায়ে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক এভিয়েশন সংস্থাগুলোকে বিমানবন্দরটির নতুন মর্যাদার বিষয়ে জানিয়ে দিয়েছে। তবু, বিস্তীর্ণ বিনিয়োগের পরও কোনো এয়ারলাইন কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালুর ঘোষণা দেননি।
সরকারের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা আর এয়ারলাইনগুলোর বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে স্পষ্ট ফারাক দেখা যাচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়নে রাষ্ট্র বিপুল অর্থ ব্যয় করলেও এয়ারলাইনগুলোর অভিযোগ, কক্সবাজার এখনও পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণ ও পর্যটন-সুবিধা গড়ে তুলতে পারেনি।
কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প জেলার জন্য নেয়া তিন লাখ কোটি টাকার মেগা পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এবং সরাসরি রেল সংযোগের সঙ্গে বিমানবন্দরকে একটি মূল প্রবেশদ্বার হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটিকে “দুবাইয়ের মতো উড়োজাহাজের রিফুয়েলিং গেটওয়ে” হিসেবে গড়ে তোলার কথা জানিয়েছিলেন।

বিমানবন্দর উন্নয়নে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে রানওয়ের দৈর্ঘ্য ৬,৭৭৫ ফুট থেকে ৯,০০০ ফুট পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়েছে এবং প্রস্থ ২০০ ফুট করা হয়েছে। সমুদ্রের ভেতরে আরও ১০,৭০০ ফুট পর্যন্ত সম্প্রসারণের কাজ চলছে। এর ফলে ওয়াইড বডির এয়ারক্রাফট নিরাপদে ওঠা-নামা করতে পারবে। নতুন আন্তর্জাতিক টার্মিনাল ভবন, যার জন্য ৩৬২ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। এতে বছরে ১৮ লাখ যাত্রী সেবা দেওয়া যাবে, যা বর্তমান সক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি।
বেবিচকের সদস্য (পরিচালনা ও পরিকল্পনা) এয়ার কমডোর আবু সাঈদ মেহবুব খান বলেন, আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের জন্য আইসিএও-কে জানানো হয়েছে, ২ অক্টোবর থেকে বিমানবন্দরটি আন্তর্জাতিক মর্যাদা পাবে। তিনি জানান, ইউএস-বাংলা, বিমান বাংলাদেশ ও কিছু বিদেশি এয়ারলাইনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে এখনো কোনো এয়ারলাইন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেনি। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সীমিত সংখ্যক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট শুরু হতে পারে এবং মার্চের মধ্যে ফ্লাইট সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ, ইউএস-বাংলা, নভোএয়ার ও এয়ার অ্যাস্ট্রা স্থানীয়ভাবে কক্সবাজারে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু করতে স্থানীয় ও বিদেশি এয়ারলাইনগুলোর সঙ্গে একাধিক দফা বৈঠক হয়েছে। তবে এয়ারলাইনগুলোর সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক ভিত্তিতে। ইউএস-বাংলা ও বিমান বাংলাদেশ সম্ভাব্য রুট যাচাই করছে। ইউএস-বাংলার মুখপাত্র কামরুল ইসলাম বলেন, ঢাকা–কক্সবাজার–ব্যাংকক রুট বিবেচনা করা হচ্ছে, কিন্তু পর্যাপ্ত যাত্রী না থাকায় ট্রানজিট খরচ মেটানো কঠিন হবে।

বিদেশি এয়ারলাইনস অপারেটরদেরও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বাণিজ্যিক সম্ভাবনা ও নিরাপত্তার ওপর নির্ভর করবে। এয়ারলাইন্স অপারেটরস কমিটির সভাপতি দিলরুবা আখতার জানান, এখনো কোনো এয়ারলাইন ফ্লাইট শুরু করার সিদ্ধান্ত নেনি। স্থানীয় ও বিদেশি এয়ারলাইন কর্মকর্তারা উল্লেখ করেছেন, সরকার কক্সবাজারকে বৈশ্বিক পর্যায়ে যথাযথভাবে প্রচার করতে পারেনি। পর্যাপ্ত বিনোদন ও পর্যটন সুযোগ না থাকায় বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ সীমিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক প্রয়োজনে নির্মিত কক্সবাজার বিমানবন্দর স্বাধীনতার পর থেকে অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেতে আইসিএও-র সব মানদণ্ড পূরণ করতে হবে—রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, আলোকসজ্জা, ন্যাভিগেশন সুবিধা, টার্মিনাল ইমিগ্রেশন, কাস্টমস, কোয়ারেন্টাইন, নিরাপত্তা, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ও কার্গোসেবা।
সরকারের উদ্যোগে বিদ্যুৎকেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর ও পর্যটন প্রকল্পসহ অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনা সামলানোর জন্য রানওয়ে সম্প্রসারণ ও নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। ২০২১ সালে রানওয়ে সম্প্রসারণ কাজ একটি চীনা যৌথ উদ্যোগে দেয়া হয়। নতুন টার্মিনাল ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। এ সময় বিদ্যমান টার্মিনাল থেকে ডিপারচার চলবে, তবে এরাইভ্যালের জন্য নতুন ভবনের একটি অংশ ব্যবহার হবে। ইমিগ্রেশন, কাস্টমস, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ব্যাংকসহ অন্যান্য সেবার কাউন্টার বসানো হচ্ছে।
সম্প্রসারিত রানওয়ে পুরোপুরি ব্যবহার করতে আলোকসজ্জা, ইন্সট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম ও ফ্লাইট ক্যালিব্রেশন কাজ বাকি আছে। এগুলো শেষ হলে আগামী বছরের শুরুতে পুরো রানওয়ে সচল হবে। বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক করার লক্ষ্য স্থানীয় ও বিদেশি পর্যটকদের সহজে আসা-যাওয়া নিশ্চিত করা এবং দক্ষিণ এশিয়ার একটি শীর্ষ হাব হিসেবে গড়ে তোলা। সরকার ৪৮ ঘণ্টার ভিসা-অন-অ্যারাইভালেরও পরিকল্পনা করেছে, যা পর্যটক সংখ্যা বাড়াতে সহায়তা করবে।

বর্তমানে বিমানবন্দর প্রতিদিন ১,৫০০–২,০০০ যাত্রী সেবা দিচ্ছে, পিক সিজনে সংখ্যাটি বেড়ে ২,৫০০ হয়। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হলে প্যাসেঞ্জার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা দ্বিগুণের বেশি হবে। আন্তর্জাতিক কার্গো অপারেশন এখনও শুরু হয়নি।
দেশি ও বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করতে বেজা তিনটি পর্যটন পার্কের পরিকল্পনা নিয়েছিল—সাবরাং, নাফ ও সোনাদিয়া। সোনাদিয়া প্রকল্প বাতিল হয়েছে, নাফ পার্কও সম্পূর্ণ হয়নি। সাবরাং ট্যুরিজম পার্কও এখনও পূর্ণাঙ্গ হয়নি। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন জানান, সাবরাংয়ের কাজ চলমান, তবে প্রাথমিকভাবে পাঁচটি অগ্রাধিকারভিত্তিক অর্থনৈতিক অঞ্চলে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। সাবরাংয়ের উন্নয়নে ১০ বছরের আলাদা পরিকল্পনা রয়েছে।
পরিশেষে, কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে চলেছে। রানওয়ে সম্প্রসারণ, নতুন টার্মিনাল এবং আন্তর্জাতিক সেবা কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে পর্যটক আকর্ষণ, পর্যাপ্ত বিনোদন সুবিধা ও পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক প্রচারণা না থাকায় এয়ারলাইনগুলো এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। স্থানীয় পর্যটন খাত, অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিদেশি এয়ারলাইনগুলোর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বয় করতে পারলে কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে সফলতা পাবে।

