বাংলাদেশে বেকারত্বের সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বহু উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার পেশাজীবী চাকরি হারিয়েছেন। হঠাৎ আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছেন, কেউ কেউ আবার কম বেতনের কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে যুক্ত বহু পেশাজীবী চলতি বছরের শুরু থেকে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক সংস্থার অর্থায়নে চলা বিভিন্ন প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে চাকরি বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়েছে বহুগুণ। চাকরি খোঁজার চেষ্টায় অনেকে একাধিক প্রতিষ্ঠানে সাক্ষাৎকার দিলেও নিয়োগ পাননি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা তহবিল ইউএসএইডের নানা প্রকল্প স্থগিত বা বাতিল হওয়ায় উন্নয়ন খাত ব্যাপক সংকটে পড়েছে। গত কয়েক দশক ধরে ইউএসএইড বাংলাদেশে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, জ্বালানি, পরিবেশ ও গণতন্ত্র খাতে উল্লেখযোগ্য অর্থায়ন করেছে। কিন্তু তহবিল কমে যাওয়ার ফলে একের পর এক প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়, কর্মহীন হয়ে পড়েন হাজার হাজার উন্নয়নকর্মী।
একই সময়ে দেশের পোশাকশিল্পে ব্যাপক ছাঁটাই চলছে। শিল্পাঞ্চল পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে দুই শতাধিক গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, প্রকৃত সংখ্যা তিন শতাধিক। ফলে এই খাতে কর্মরত বিপুলসংখ্যক শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। অনেক পরিবারে একাধিক আয়ের উৎস থেকে এখন একমাত্র উপার্জনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সঞ্চয় ফুরিয়ে যাওয়ায় ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা চরম অনিশ্চয়তায় রয়েছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার বেশি। শুধু ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই ২১ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চাকরি হারানোদের মধ্যে ৮৫ শতাংশই নারী।
অর্থনীতিবিদদের মতে- রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগ স্থবিরতা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কর্মসংস্থানের পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। নতুন চাকরি তৈরি না হয়ে বরং বিদ্যমান কর্মসংস্থানও কমেছে। তারা মনে করেন, সঠিক পরিসংখ্যানের অভাব নীতি প্রণয়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চাকরি বাজারে প্রবেশ করতে গিয়ে অভিজ্ঞ প্রার্থীরাও চরম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছেন। অনেক সংস্থা নতুন চাকরির বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে না বা অভ্যন্তরীণভাবে নিয়োগ দিচ্ছে। অন্যদিকে নতুন প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ায় প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হচ্ছে। বয়স ও অভিজ্ঞতা অনেক সময় চাকরির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এছাড়া পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা বেড়েছে। অনেকেই হাঁটাহাঁটি করে অফিসে যাচ্ছেন, কারণ যাতায়াত খরচ বাঁচাতে হচ্ছে। পরিবারের নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব আনএমপ্লয়েড ডেভেলপমেন্ট প্রফেশনালস জানিয়েছে, শুধু ইউএসএইডের তহবিল স্থগিত হওয়ার কারণেই ৫০ হাজারের বেশি মানুষ কর্মহীন হয়েছেন। তাদের ৭০ শতাংশের বেশি এখনও চাকরি পাননি। অনেকে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন, আবার কেউ মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
বাংলাদেশের শ্রমবাজারে সংকট দিন দিন তীব্র হচ্ছে। আয় কমে যাওয়া পরিবারগুলো দারিদ্র্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। চাকরি সংকট নিরসনে বড় বিনিয়োগ ছাড়া পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা বিশেষজ্ঞরা দেখছেন না।

