রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বাড়ছে সহিংসতা ও অপরাধ। একের পর এক ঘটছে গণসহিংসতা, খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, অপহরণ, চুরি ও চোরাচালান। মানুষ এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে থাকলেও পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পর্যাপ্ত ক্ষমতা হাতে পেয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি সফল হয়নি। সংশ্লিষ্টদের মতে, কঠোর অবস্থানে যেতে না পারার কারণেই অপরাধ বাড়ছে। অনেক পুলিশ সদস্য নিজেরাই ট্রমায় ভুগছেন, বিশেষ করে মব হামলার আতঙ্কে। পাশাপাশি সরকারের মানবাধিকার রক্ষার নীতি ও স্থানীয় রাজনৈতিক সহযোগিতা না পাওয়ায় তারা সক্রিয়ভাবে এগোতে পারছেন না।
গত এক বছর এক মাসে ৩৩৪টি গণসহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২১৯টিতে ভিকটিম হয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। ১২ বার আক্রমণ হয়েছে থানায়। আসামি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে ৫৭ ঘটনায়। এছাড়া অন্যান্যভাবে পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে ১৫০ বার। ছাত্র দেখলেই এখনো অনেক পুলিশ আতঙ্ক বোধ করেন।
জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশে হয়েছে ২ হাজার ২১৬টি হত্যাকাণ্ডের মামলা। একই সময়ে ডাকাতি ৪২৬টি, অপহরণ ৬২৫টি, চুরি ৫ হাজার ৩৮৭টি, চোরাচালান ১০ হাজার ১০৯টি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৪৯২টি ধর্ষণ ঘটেছে। অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে ২৯টি, কারাগারে মৃত্যু হয়েছে ৬১ জনের। এ সময় আক্রমণের শিকার হয়েছেন ১৬৫ সাংবাদিক। রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহত হয়েছেন ৬ হাজার ৩৯০ জন। ধর্ষণের শিকার ৪৮৮ নারী। গণপিটুনিতে নিহত ১০৮ জন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঘাটতি কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা। রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে পুলিশের কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ার সুযোগ নিচ্ছে তারা। এতে দখল, ভাঙচুর ও চাঁদাবাজি বেড়েছে।
অন্যদিকে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম জানান, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাধারণ মানুষের ক্ষোভের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় পুলিশ। এতে তারা মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। তবে তার দাবি, গত এক বছরে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে এবং দ্রুত আরও উন্নতি হবে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত ৮০টি মাজারে হামলা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের মব ভায়োলেন্স ঘটেছে ৩৫টি। সব ক্ষেত্রে মামলা হয়নি। পুলিশের তৈরি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৩৩৪টি গণসহিংসতার মধ্যে ৬৫ শতাংশ ঘটনায় ভিকটিম পুলিশ সদস্যরা। আসামি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে ২৬ শতাংশ ঘটনায়। থানা আক্রমণ হয়েছে প্রায় ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ঘটনায়।
সাম্প্রতিক কিছু সহিংসতা
- রাজধানীর মালিবাগে সোহাগ পরিবহণের মালিকের বাসা ও কাউন্টারে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। আতঙ্কে নারী ও শিশুরা ছোটাছুটি করে। আহত হন অন্তত ১৫ জন।
- মোহাম্মদপুরে পুলিশ কনস্টেবল আল-আমিন কিশোর গ্যাংয়ের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত হন। আরও কয়েকজনও জখম হন।
- মার্চে মোহাম্মদপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় আসামি গ্রেপ্তারে গেলে পুলিশ মব হামলার শিকার হয়।
- আগস্টে ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও চাঁদপুরে ঘটে একের পর এক গণসহিংসতা। কিশোর মাহিন নিহত হন। পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
- ৩১ আগস্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় শতাধিক শিক্ষক-কর্মকর্তা অবরুদ্ধ হন। বিএনপি ও যুবলীগ নেতাদের উসকানিদাতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
- ৭ আগস্ট গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামানকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
- ৯ জুলাই মিটফোর্ড হাসপাতালে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়।
পরিস্থিতি স্পষ্ট—সহিংসতা ও অপরাধ বেড়েই চলেছে। পুলিশ মাঠে থাকলেও কার্যকর পদক্ষেপে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও মানবাধিকার নীতির কারণে কঠোর অবস্থান নিতে পারছে না তারা। এর সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। ফল ভোগ করছে সাধারণ মানুষ।

