দুই দফায় বরিশাল ক্যানসার, কিডনি ও হৃদরোগ বিশেষায়িত হাসপাতালের নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৩৯ কোটি টাকা। কিন্তু প্রকল্প নির্মাণ কাজ এখনো শেষ হয়নি। নির্মাণ সম্পন্ন করতে আরও দুই বছর সময় চেয়ে গণপূর্তের কাছে আবেদন করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বর্ধিত এই সময়ের মধ্যে ক্যানসার হাসপাতাল নির্মাণকাজ সম্পন্ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যানসার, কিডনি ও হৃদরোগের জন্য ৪৬০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সেই অনুযায়ী শেবাচিম হাসপাতালের সমানে স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় ১৪ হাজার বর্গফুটের ১৭ তলার ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২০ সালের নভেম্বরে। মেসার্স খান বিল্ডার্স নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি অনুযায়ী ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার কথা ছিল।
কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজের ধীরগতির কারণে ২০২৩ সালে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। ওই সময়ের মধ্যে বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠান। পরে প্রথম দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। দ্বিতীয় দফায় ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এই সময়ের মধ্যে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ। ফলে তৃতীয় দফায় আরও দুই বছরের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে।
গণপূর্ত দপ্তর জানান, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশেষায়িত ক্যানসার হাসপাতাল প্রকল্পের ডিপিপি মূল্য নির্ধারণ করা হয় ২৩৮ কোটি ৮৩৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৯৯ কোটি ৫১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা চুক্তিমূল্যে বেজমেন্টসহ ১৫ তলা ভবন নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। দুই দফায় প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি করায় প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩৯ কোটি টাকা। যা ডিপিপি মূল্যের চেয়ে প্রায় এক কোটি টাকা বেশি।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স খান বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপক রিপন তালুকদার বলেন, ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার কথা থাকলেও বরাদ্দ না পাওয়াসহ নানা সীমাবদ্ধতায় চুক্তি অনুযায়ী কাজ শেষ করতে পারেননি তারা। প্রকল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু আমরা কাজের বিল পুরোটি পাইনি। বিল না পেলে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। তার পরও কমসংখ্যক শ্রমিক দিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়া হচ্ছে।
বরিশাল গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী কামাল হোসেন বলেন, অর্থ বরাদ্দ না থাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিল পরিশোধে বিলম্ব ও যন্ত্রপাতি আমদানি জটিলতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ধীরগতিতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, নতুন করে প্রকল্পের ব্যয় বাড়েনি। হিসাব অনুযায়ী শুধু মাত্র অবকাঠামো নির্মাণ কাজ এখন পর্যন্ত ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। পুরো কাজ শেষ হতে এখনো দুই বছর সময় লাগবে। তাই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরপরই নতুন করে দুই বছর সময় বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন পাঠানো হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর অনুমোদন হয়নি। তবে শিগগিরই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিল পরিশোধ করাও সম্ভব হবে।
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতাল সূত্রে জানাজায়, শেবাচিম হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগে ২৭ শয্যার ক্যানসার ওয়ার্ড রয়েছে। জেলা ও উপজেলাগুলোতে ক্যান্সারের কোনো চিকিৎসাসেবা না থাকায় শেবাচিম হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৩৮ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। গত এক বছরে ক্যান্সারে আক্রান্ত চার হাজার ৮০১ জন এখানেই চিকিৎসা নিয়েছেন।
হাসপাতালের অনকোলজি বিভাগের চিকিৎসক ফারহানা খান বলেন, ক্যান্সার রোগীদের কেমোথেরাপি বা ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা, রেডিওথেরাপি বা বিকিরণ চিকিৎসা অর্থাৎ ক্যান্সার কোষ বিশেষ আলোকরশ্মির মাধ্যমে মেরে ফেলা এবং অস্ত্রোপচারের। রোগীদের প্রায় ৬০ শতাংশকে রেডিওথেরাপি দেওয়ার প্রয়োজন। কিন্তু রেডিওথেরাপি যন্ত্রটি নষ্ট থাকায় রোগীদের থেরাপি দেওয়া যাচ্ছে না। তাঁদের ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হলেও অর্থের অভাবে অনেকেই যেতে পারেন না। রেডিওথেরাপি নষ্ট থাকায় শুধু রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
শেবাচিম হাসপাতাল ছাড়া জেলা পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্তকরণের জন্য স্ক্রিনিং পরীক্ষাসহ কোনো ব্যবস্থা নেই। তিনি আরও বলেন, বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৩৮ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন।
রেডিওথেরাপি বিভাগের মেডিকেল অফিসার মো. মহসীন হাওলাদার বলেন, আশপাশের জেলা থেকে রোগীরা এখানে চলে আসেন। যদি জেলা পর্যায়ে কিছু চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হতো, রোগীদের ভোগান্তিও কমে যেত।
হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘জনসংখ্যা অনুপাতে ২০টি রেডিওথেরাপি যন্ত্র প্রয়োজন। কিন্তু তার বিপরীতে আছে একটি, সেটিও বন্ধ। যন্ত্রটি সচলের জন্য প্রতি মাসেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত করা হচ্ছে।
বরিশাল জনগণের স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক রফিকুল আলম বলেন, এ অঞ্চলের চিকিৎসা ব্যবস্থা সহজ ও যুগোপযোগী করে তুলতে প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি। আমরা চাই এসব প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। এটা থমকে গেলে আমাদের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হবে।

