সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব বিএনপিকে গ্রহণ করার অনুরোধ জানায় অন্তর্বর্তী সরকার। তবে বিএনপি সেই প্রস্তাব মেনে নেয়নি।
সরকার ও বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গত ৩১ আগস্ট রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির বৈঠকে এ প্রসঙ্গ ওঠে। সরকারের একজন উপদেষ্টা এ সময় বিএনপিকে প্রস্তাবটি ভেবে দেখার অনুরোধ জানান।
বিএনপির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, “বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। আমরা বলেছি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে এটি ইতিমধ্যেই চূড়ান্ত হয়েছে। যদি কোনো সাংবিধানিক বা বৈধ উপায় থাকে, বিএনপি তা মানতে প্রস্তুত।”
উচ্চকক্ষ নিয়ে ভিন্নমত
ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সংসদের উচ্চকক্ষ বা সিনেটে সদস্য হবে ১০০ জন। নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে দলগুলো আসন পাবে। অর্থাৎ, একটি দল ৩০০ আসনে যত ভোট পাবে, তার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে তাদের প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণ হবে।
তবে বিএনপি ও এনডিএম এ প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে। তারা চায় নিম্নকক্ষে যে দল যত আসন পাবে, সেই অনুযায়ী উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন হোক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপির প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে উচ্চকক্ষ আসলে নিম্নকক্ষের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়াবে। এতে উচ্চকক্ষের মূল উদ্দেশ্য—আইনসভায় ভারসাম্য আনা ও একক দলের ইচ্ছামতো সংবিধান পরিবর্তন ঠেকানো—ব্যর্থ হবে।
সংসদ গবেষক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন, “ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত যথেষ্ট যৌক্তিক। এতে সংসদে ভারসাম্য আসবে। তবে বিএনপি যেভাবে উচ্চকক্ষ চায়, তা অযৌক্তিক ও অর্থের অপচয়।”
গত জুনে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পর থেকে বিএনপির অবস্থান আরও শক্ত হয়েছে বলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে। জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) মনে করছে, সরকারের সঙ্গে বিএনপির বিশেষ সমঝোতা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত জুলাই সনদ নিয়েও দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। বিএনপির ভিন্নমত রয়েছে ৯টি প্রস্তাবে। জামায়াত ও এনসিপি চাইছে, জাতীয় নির্বাচনের আগেই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। তারা গণভোট বা গণপরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়নের দাবি তুলেছে। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, সংসদ ছাড়া সাংবিধানিক প্রস্তাব বাস্তবায়নের বৈধ পথ নেই। তাই আগামী সংসদ গঠনের পর দুই বছরের মধ্যে এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের পক্ষে তারা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, সামগ্রিকভাবে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। উচ্চকক্ষের গঠনপদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত থাকায় গণভোটের প্রস্তাবও বিবেচনায় আনা হতে পারে।
কেন দরকার দ্বিকক্ষীয় সংসদ
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, এককক্ষীয় সংসদ ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত বিতর্ক ছাড়াই দুর্বল আইন পাস হয়েছে। এতে শাসক দলের হাতে ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ ঘটেছে। এজন্য সংসদীয় ব্যবস্থায় ভারসাম্য আনার লক্ষ্যে দ্বিকক্ষীয় সংসদের প্রস্তাব করা হয়।
প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষ সরাসরি আইন প্রণয়ন করবে না। তবে নিম্নকক্ষের প্রণীত আইন পর্যালোচনা ও সংশোধনের সুপারিশ করতে পারবে। সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত যেকোনো বিল উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস হতে হবে। ফলে এককভাবে সংবিধান সংশোধনের সুযোগ কঠিন হবে।
বিএনপি তাদের ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবেও উচ্চকক্ষের কথা বলেছে। তবে তাদের মূল ভাবনা, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রথিতযশা ব্যক্তিদের সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা। বিএনপি বলছে, এতে জাতি উপকৃত হবে।
অন্যদিকে কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, উচ্চকক্ষে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ থাকবে না। কারণ, কোনো দল যদি ৫০ শতাংশ ভোট না পায়, তাহলে এককভাবে আধিপত্য বিস্তার করা সম্ভব নয়। এতে উচ্চকক্ষ তুলনামূলকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ ও বহুদলীয় প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে।

