ছয় বছর বিরতির পর আবারও অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। আগামীকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলবে ভোটগ্রহণ।
গত ২৬ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া টানা ১৩ দিনের প্রচারণা শেষ হয়েছে গতকাল রবিবার (৭ সেপ্টেম্বর)। প্রার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক এলাকা, টিএসসি, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে, মল চত্বর ও কার্জন হলে দিনভর প্রচারণা চালান।
রাতে তাঁরা ছুটে যান আবাসিক হলে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন, তাঁদের দাবিদাওয়া শোনেন এবং নিজেদের ইশতেহার তুলে ধরেন। নারী ভোটারদের লক্ষ্য করে হলে হলে প্রজেকশন মিটিংও করেছেন বিভিন্ন প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
ভোট শেষে গণনা করা হবে ওএমআর মেশিনে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতিমধ্যেই এর ব্যবস্থা করেছে। নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে হাতে গুনে ১০টি ব্যালট পেপার গণনা করা হবে। এরপর একই ব্যালটগুলো মেশিনে দেওয়া হবে। হাতে গোনা ফলাফল ও মেশিনের ফলাফল মিলে গেলে ওএমআর পদ্ধতিতে পুরো ভোট গণনা করা হবে।
নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের গুজবে কান না দেওয়ার আহবান জানিয়েছেন প্রধান রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন। গতকাল নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের সামনে ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন,
“গুজব একটি সামাজিক ব্যাধি। বাস্তবে কিছু না ঘটলেও নানা গুজব ছড়ায়। ডাকসু নির্বাচন নিয়েও বিভিন্ন গুজব তৈরি হতে পারে—কেউ নাকি সরে দাঁড়ালেন, কেউ নাকি অন্যকে সমর্থন করছেন। এসব কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে সবাইকে ভোটকেন্দ্রে যেতে হবে।”
ডাকসু নির্বাচন: গুজব এড়িয়ে ভোটে আসার আহবান, শপথে ছাত্রদল, সমালোচনায় বিরোধী প্যানেল
ছয় বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনা বাড়ছে। ভোটের আগের দিন একদিকে যেমন প্রার্থীরা নানা অঙ্গীকারে শপথ নিচ্ছেন, অন্যদিকে সমালোচনা ও শঙ্কার কথাও উঠে আসছে বিভিন্ন প্যানেলের বক্তব্যে।
প্রধান রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন শিক্ষার্থীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন, নির্বাচনের সময় কোনো গুজবে কান না দিতে। তিনি বলেন,
“গুজব একটি সামাজিক ব্যাধি। নির্বাচন নিয়ে যদি কোনো ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ায়, সেটিকে গুরুত্ব না দিয়ে সরাসরি রিটার্নিং অফিসারদের কার্যালয়ে যোগাযোগ করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইট থেকে সঠিক তথ্য নিন।”
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা গতকাল রবিবার কলা অনুষদের বটতলায় শপথ নেন। শপথ পাঠ করান ভিপি প্রার্থী মো. আবিদুল ইসলাম খান।
প্রার্থীরা অঙ্গীকার করেন, নির্বাচিত হলে রাজনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলবেন, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখবেন এবং প্রতিপক্ষের সঙ্গে গণতান্ত্রিক আচরণ করবেন।
তাঁদের শপথের মূল প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে ছিল—
- গণরুম ও গেস্টরুম নির্যাতন বন্ধ করা, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা।
- দেশের গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দৃঢ় থাকা।
- নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করা।
- সব শিক্ষার্থীর জন্য বৈধ আসন, সাশ্রয়ী খাবার, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও সহজলভ্য পরিবহন ব্যবস্থা।
- সাইবার বুলিং, গুজব ও ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান।
- শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন, খেলাধুলা-সংস্কৃতির প্রসার এবং ক্যারিয়ার গঠনের সুযোগ বৃদ্ধি।
- ডাকসুর অভ্যন্তরে রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও পারস্পরিক সৌজন্য বজায় রাখা।
- সমালোচনায় বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ
অন্যদিকে, ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী আবু বাকের মজুমদার অভিযোগ করেছেন, নির্বাচন কমিশন প্রতিদিন তার নিরপেক্ষতা হারাচ্ছে।
তিনি বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভোটকেন্দ্র নির্ধারণেও তিনি অসঙ্গতির অভিযোগ তোলেন।
কার্জন হলে একটি ভবনে তিনটি কেন্দ্র দেওয়া হয়েছে, যা তাঁর মতে অযৌক্তিক। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল ও কুয়েত মৈত্রী হলের ভোটকেন্দ্র রাখা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে। এমন সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
“ফোনে ভোট চাপানো ফ্যাসিবাদী কায়দা”
‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’-এর ভিপি প্রার্থী আবু সাদিক কায়েম অভিযোগ করেছেন, শিক্ষার্থীদের ফোন দিয়ে ভোট দিতে বাধ্য করা ফ্যাসিবাদী কায়দা।
তিনি বলেন-
“আমরা চাই শিক্ষার্থীদের কাছে সরাসরি গিয়ে তাঁদের আশা-প্রত্যাশা শুনতে। কোনো বড় নেতা বাইরে থেকে ফোন দিয়ে চাপিয়ে ভোট নেওয়া গণতান্ত্রিক নয়, এটা নিছক ফ্যাসিবাদ।”
ডাকসু নির্বাচন ঘিরে নতুন সমীকরণ, শঙ্কা ও প্রস্তাবনার ঝড়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন ঘিরে নানা বক্তব্য ও প্রস্তাবনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট থেকে শুরু করে নির্বাচন সুষ্ঠু আয়োজনের দাবিতে শিক্ষক ও প্রার্থীদের একাধিক মন্তব্য আলোচনায় এসেছে।
অনাবাসিক শিক্ষার্থীরাই “গেম চেঞ্জার”: মেঘমল্লার
বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর প্যানেল ‘প্রতিরোধ পর্ষদে’র জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসু মনে করেন, অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট ডাকসুর নির্বাচনী সমীকরণ বদলে দেবে।
গতকাল দুপুরে মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়লে ভোটের ফলাফল ভিন্ন হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক নির্বাচনে অনিয়মের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির নেতারা ১০ দফা সতর্কতামূলক দাবি জানান।
তাঁরা বলেন, ২০১৯ সালের নির্বাচনে সুষ্ঠুতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এবারের নির্বাচনেও একই অভিজ্ঞতা যেন না হয়, সেজন্য প্রশাসনকে আগেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কিছু প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলেও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় উপেক্ষিত রয়ে গেছে বলেও তাঁরা অভিযোগ করেন।
নির্বাচন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ করতে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স লিংক (ইউটিএল) নির্বাচন কমিশনের কাছে ১০ দফা প্রস্তাব দিয়েছে।
প্রধান রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানীর কাছে জমা দেওয়া প্রস্তাবগুলোতে রয়েছে—
- ভুয়া ভোটার ও জাল ভোট রোধ
- ওএমআর মেশিনের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ
- কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল ঘোষণা
- আচরণবিধি কঠোরভাবে মেনে চলা
- নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা
- ক্যাম্পাসে সামগ্রিক নিরাপত্তাব্যবস্থা
- প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি
- প্রচারণায় গণআস্থা বাড়ানো
- কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও সহায়তা কেন্দ্র
- ফলাফল প্রকাশের পর শৃঙ্খলা বজায় রাখা
- ভোটগণনা সরাসরি এলইডি স্ক্রিনে
এদিকে ডাকসু নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ভোট শেষে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে এলইডি স্ক্রিনে সরাসরি ফলাফল দেখানো হবে। গতকাল রাতে প্রধান রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
এর মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও শিক্ষার্থীদের আস্থা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়।

