প্রায় পৌনে ১৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দেশের দীর্ঘতম রেলসেতু ‘যমুনা রেলসেতু’। এ সেতুর উদ্বোধনের সময় ঘোষণা এসেছিল—প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৮৮টি ট্রেন চলবে এই করিডরে। কিন্তু উদ্বোধনের প্রায় ছয় মাস পর বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। প্রতিদিন চলছে গড়ে মাত্র ৩৫টি ট্রেন। অর্থাৎ সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকেরও কম।
রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, লোকোমোটিভ ও কোচের অভাব, ডাবল লাইন না থাকা এবং আধুনিক সংকেত ব্যবস্থা এখনো পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় এ পরিস্থিতি। গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত করিডর এখনো সিঙ্গেল লাইন। ফলে একসঙ্গে বেশি ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি ইঞ্জিন ও বগি ঘাটতির কারণে নতুন ট্রেন যুক্ত করাও যাচ্ছে না।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধু সেতু নির্মাণ করলেই হবে না, এর আগে–পরে থাকা পুরো রেল করিডরকে ডাবল লাইন ও আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থায় রূপান্তর করতে হবে। অন্যথায় বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ করেও কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেছেন, “সমীক্ষায় হয়তো পুরো করিডরের বাস্তব পরিস্থিতি যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয়নি। সিঙ্গেল লাইন থাকলে সেতুর পূর্ণ সুবিধা পাওয়া যাবে না। এতে আয়ও বাড়বে না, বিনিয়োগও উঠবে না।”
যাত্রায় কিছুটা সুবিধা মিলেছে, তবে সীমাবদ্ধতাও রয়ে গেছে
যদিও সেতুটি চালু হওয়ার পর ট্রেনযাত্রায় কিছুটা গতি এসেছে। যমুনা পাড়ি দেওয়া ট্রেনগুলোকে আর দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। আগে ক্রসিং জটের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হতো, এখন সেই ঝক্কি কমেছে। তবে সংকেতব্যবস্থা এখনো ম্যানুয়াল বা হাতে নিয়ন্ত্রিত। পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় সংকেত চালু হলে আরও সময় সাশ্রয় হবে এবং নিরাপত্তাও বাড়বে।
রেলওয়ের হিসাব বলছে, নতুন সেতুতে সক্ষমতা বাড়াতে জয়দেবপুর–ঈশ্বরদী ডাবল লাইন করা, বগুড়া–সিরাজগঞ্জ এবং পার্বতীপুর–কাউনিয়া রুট ডাবল লাইন করার পরিকল্পনা আছে। পাশাপাশি নতুন লোকোমোটিভ ও কোচ সংগ্রহ এবং আধুনিক সংকেত চালু করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। তবে এসব প্রকল্প এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে।
প্রকল্পের সময় ও ব্যয় দুই-ই বেড়েছে
যমুনা রেলসেতুর মূল নির্মাণকাজ শেষ হলেও কিছু অতিরিক্ত কাজ বাকি। প্রকল্পের অগ্রগতি ৯৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ হলেও সংকেত, রেলওয়ে ব্রিজ মিউজিয়াম, ইন্সপেকশন বাংলো, এক্সিবিশন হল, ক্যাফেটেরিয়া, অভ্যন্তরীণ সড়ক, মাটি ভরাট ও ড্রেনেজের মতো কাজ এখনো শেষ হয়নি।
প্রকল্পের ব্যয় প্রথমে নির্ধারিত ছিল ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটিরও বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৭২ শতাংশ অর্থায়ন করেছে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা, বাকি এসেছে দেশীয় তহবিল থেকে।
চুক্তি অনুযায়ী ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন অতিরিক্ত কাজ বাকি থাকায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও দেড় বছর বাড়িয়ে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্প পরিচালক জানিয়েছেন, সংকেতব্যবস্থার কাজ চলতি বছরের অক্টোবরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তবে অন্যান্য নির্মাণকাজ শেষ করতে আরও সময় লাগবে।
ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন জানিয়েছেন, বর্তমানে ইঞ্জিন ও কোচের সংকট রয়েছে। পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের করিডরে ডাবল লাইন না থাকায় পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তবে নতুন কোচ আনার প্রকল্প চলমান এবং জয়দেবপুর–ঈশ্বরদী ডাবল লাইনের কাজও শিগগির শুরু হবে। এসব কাজ শেষ হলে যমুনা রেলসেতুতে প্রতিদিনের ট্রেন চলাচল বাড়ানো সম্ভব হবে।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল রেলসেতুতে এখনো যাত্রীদের পুরো সুবিধা মিলছে না। তবে রেলওয়ে আশাবাদী—সব অবকাঠামো আধুনিকীকরণ হলে যমুনা রেলসেতু শুধু উত্তর–দক্ষিণের রেল যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্রই হবে না, বরং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আঞ্চলিক বাণিজ্যের জন্যও নতুন দ্বার খুলে দেবে।