বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি হওয়ার কথা ছিল বিপুল শ্রমশক্তি। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। কোটি মানুষ কাজ করলেও তাদের বড় অংশ উৎপাদনশীল নয়। শিক্ষিত তরুণরা ডিগ্রি নিয়েও বসে আছেন বেকার হয়ে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)–এর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, দেশে মোট কর্মে নিয়োজিত জনসংখ্যা ৬৯.০৯ মিলিয়ন। এর মধ্যে সাক্ষর ৫৬.০৭ মিলিয়ন হলেও নিরক্ষর রয়েছেন ১৩.০২ মিলিয়ন, অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ। এই নিরক্ষর কর্মশক্তি শিল্প ও সেবা খাতে দক্ষতার ঘাটতি তৈরি করছে। ফলে অনেকেই কাজ পেলেও আয় কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে না।
ছদ্ম বেকারত্বের ভয়াবহতা
বিবিএসের সংজ্ঞা অনুযায়ী, সপ্তাহে অন্তত এক ঘণ্টা কাজ করলেই কেউ কর্মে নিয়োজিত হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—বাংলাদেশের বাস্তবতায় এক ঘণ্টার কাজ কতটা জীবিকা নির্বাহের নিশ্চয়তা দেয়? এই সংজ্ঞার কারণে দেশে ‘ছদ্ম বেকারত্ব’ বেড়েছে। জরিপে বলা হয়েছে, প্রায় এক কোটি মানুষ তাদের যোগ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চাকরি পাচ্ছেন না।
সরকারি হার বনাম বাস্তব চিত্র
সরকারি হিসাবে দেশে বেকারত্বের হার ৩.৬৬ শতাংশ। সংখ্যায় তা দাঁড়ায় ২৬ লাখ ২৪ হাজারে। বিভাগভিত্তিক হিসাবে ঢাকায় বেকার সংখ্যা সর্বাধিক—৬ লাখ ৮৭ হাজার। চট্টগ্রামে ৫ লাখ ৮৪ হাজার, রাজশাহীতে ৩ লাখ ৫৭ হাজার, খুলনায় ৩ লাখ ৩১ হাজার। সবচেয়ে কম বেকার ময়মনসিংহে—১ লাখ ৪ হাজার। এই ভৌগোলিক বৈষম্য নতুন চিন্তার কারণ।
শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব
দেশের বেকারদের মধ্যে সাড়ে ১৩ শতাংশ স্নাতক এবং ৭.১৩ শতাংশ উচ্চমাধ্যমিক পাস। অর্থাৎ প্রতি পাঁচজন বেকারের একজন শিক্ষিত। আরও উদ্বেগজনক, ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী যুব বেকারদের মধ্যে প্রায় ২৯ শতাংশ স্নাতক। মানে প্রতি তিনজন স্নাতক তরুণের একজন চাকরিহীন। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের এই বৈষম্য মানবসম্পদ নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
নারী শ্রমশক্তি পিছিয়ে
শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক নয়। কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে অংশগ্রহণের হার মাত্র ৩৮.৪০ শতাংশ, যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে তা প্রায় ৮০ শতাংশ। শহরাঞ্চলে এই হার আরও কম।
অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিপত্য
জরিপে দেখা যায়, কর্মে নিয়োজিতদের ৮৪ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। গ্রামে এ হার ৮৭.৫৮ শতাংশ এবং শহরে ৭৩.৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ বিপুল শ্রমশক্তি এখনো সুরক্ষা ও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত।
আয় ও সময়ের বৈষম্য
কর্মে নিয়োজিতদের গড় কর্মঘণ্টা সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা। শিল্পে ৫৩, সেবায় ৫১ এবং কৃষিতে ৩৯ ঘণ্টা। তবুও গড় আয় সন্তোষজনক নয়। মাসিক গড় আয় ১৫,৫৫৪ টাকা। পুরুষেরা গড়ে আয় করছেন ১৬,১০৫ টাকা, নারীরা মাত্র ১২,৬৮১ টাকা। শহরে গড় আয় ১৭,৭০৮ টাকা হলেও গ্রামে ১৪,১৩১ টাকায় সীমাবদ্ধ।
যুবসমাজের অস্থির ভবিষ্যৎ
জরিপে বলা হয়েছে, দেশে ১৫-২৯ বছর বয়সী যুবদের মধ্যে ২০ লাখ বেকার। যা মোট বেকারের ৭৬ শতাংশ। আরও উদ্বেগজনক, শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণে নেই এমন (নিট) তরুণের সংখ্যা ৮.৫৬ মিলিয়ন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫.৭৯ মিলিয়ন। অর্থাৎ প্রতি চারজন তরুণীর একজন কোনো শিক্ষায় বা কর্মে যুক্ত নন।
বহুমুখী বেকারত্ব
বাংলাদেশের বেকারত্ব নানা ধরনের। উত্তরবঙ্গ ও হাওর অঞ্চলে সামঞ্জস্যহীনতাজনিত বেকারত্ব দেখা যায়। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা বা মহামারির কারণে তৈরি হয়েছে বাণিজ্যচক্রজনিত বেকারত্ব। আবার প্রযুক্তির বিকাশে সৃষ্টি হয়েছে কাঠামোগত বেকারত্ব।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জরিপের তথ্য প্রমাণ করছে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের সমস্যার গভীরতা। একদিকে শিক্ষিত তরুণরা চাকরি পাচ্ছেন না, অন্যদিকে নিরক্ষর শ্রমিকরা উৎপাদনশীলতায় সীমাবদ্ধ। আঞ্চলিক বৈষম্য, অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিপত্য ও নারী অংশগ্রহণের নিম্নহার বড় সংকট তৈরি করেছে।
বাংলাদেশ যদি টেকসই প্রবৃদ্ধি ও ‘স্মার্ট অর্থনীতি’র লক্ষ্যে এগোতে চায়, তবে শ্রমবাজারে বৈষম্য কমানো ছাড়া বিকল্প নেই।

