রাজধানীর কারওয়ানবাজারে আলুর আড়তে বসে আলু বাছেন সামিয়া খাতুন, বয়স ৪৭। প্রতিদিনের মজুরি মাত্র ৬০০ টাকা। স্বামী অসুস্থ, রিকশা চালিয়ে যা আয় করেন তা নিয়মিত নয়। সংসারে মেয়েসহ দুই নাতি-নাতনি, আর এক ছেলে। পুরো পরিবার নির্ভর করে প্রায় একা সামিয়ার উপার্জনের ওপর।
কিন্তু এই উপার্জনও সব সময় নিশ্চিত নয়। গরমে অসুস্থ হয়ে তিনি নিজেই অন্তত দুইবার কাজ বন্ধ রেখেছেন, আবার তাঁর মেয়ে ও ছেলে অসুস্থ হয়েছে তিনবার করে। এভাবে কেবল এই বছরেই সামিয়ার ১১ কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে। তাঁর কথায়, “ঘাম শরীরে বইসা অসুখ বাধায়। গরম এত বাড়ছে যে কওনের কথা নাই।”
সামিয়ার অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগত নয়—এটাই এখন বাংলাদেশে লাখো মানুষের বাস্তবতা।
কর্মদিবস হারানোর ভয়াবহ চিত্র
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ২০২৪ সালেই অতিরিক্ত গরমের কারণে বাংলাদেশে প্রায় ২৫ কোটি কর্মদিবস হারিয়েছে শ্রমজীবীরা। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ২১ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবেদনে ১৯৭৬ থেকে ২০২৩ সালের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়, পাশাপাশি ১৬ হাজারের বেশি মানুষের ওপর জরিপ চালানো হয়।
ফলাফলে উঠে আসে—১৯৮০ সালের পর থেকে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ১.১° সেলসিয়াস, আর গরমের অনুভূতি বেড়েছে আরও বেশি, প্রায় ৪.৫° সেলসিয়াস। রাজধানী ঢাকায় এই বৃদ্ধি জাতীয় গড়ের চেয়ে প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি।
স্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতার সরাসরি প্রভাব
গরমে সবচেয়ে বেশি ভুগছে শ্রমজীবীরা। ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, দীর্ঘ কাশি ও চরম অবসাদ এখন নিত্যসঙ্গী। জরিপে দেখা গেছে, শারীরিক অসুস্থতার কারণে গ্রীষ্মে মানুষ গড়ে ১.৪ দিন এবং শীতে ১.২ দিন কাজ করতে পারেননি। মানসিক স্বাস্থ্যজনিত কারণে এ সংখ্যা আরও বেশি।
বিশেষ করে নিম্নআয়ের শ্রমিকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত—গ্রীষ্মে গড়ে ১.৭ দিন কাজ হারিয়েছে তারা, যেখানে ধনী শ্রেণির ক্ষতি তুলনামূলকভাবে অর্ধেকের মতো।
ঢাকার গরম ও দূষণের যোগসূত্র
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুস সালামের মতে, ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে দূষণ বড় ভূমিকা রাখছে। ব্ল্যাক কার্বন, কার্বন ডাই–অক্সাইড, মিথেনের মতো গ্যাস গাড়ির ধোঁয়া ও ইটভাটা থেকে নির্গত হয়ে উত্তাপ বাড়াচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জলাভূমি হারানোও ঢাকার গরম বাড়িয়ে তুলছে দ্রুত। গত তিন দশকে ঢাকার জলাভূমি কমেছে ৬৯ শতাংশ, আর ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়েছে ৯° সেলসিয়াসের বেশি।
ঝুঁকির মুখে ভবিষ্যৎ
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের সহলেখক ইফফাত মাহমুদ সতর্ক করে বলেন, অতিরিক্ত গরম কেবল স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে না, বরং সরাসরি উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাঁর মতে, বাংলাদেশ যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে মানবসম্পদ হারানোর ঝুঁকি ভয়াবহ রূপ নেবে।
কারওয়ানবাজারের সামিয়া খাতুন–এর মতো হাজারো শ্রমজীবী নারী-পুরুষের গল্পই আজ প্রমাণ করছে—গরম কেবল আবহাওয়ার সমস্যা নয়, এটি এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি ও মানুষের জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি।