সিলেট বিভাগের শহরগুলোতে ব্যাটারিচালিত রিকশার অযাচিত চলাচল নগরজীবনকে তীব্র সমস্যায় ফেলেছে। প্রতিদিন এই রিকশাগুলো যানজট, দুর্ঘটনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। সকালে এবং বিকেলের ব্যস্ত সময়ে হঠাৎ থেমে যাওয়া, উল্টো পথে চলাচল এবং দ্রুতগতির প্রতিযোগিতার কারণে নগরবাসীকে ভোগান্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
সরেজমিনে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন সড়কে দেখা গেছে, অধিকাংশ রিকশাচালক অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর, যারা ট্রাফিক আইন জানে না। ফলে পথচারী ও যাত্রীদের জন্য ঝুঁকি অনেক গুণ বেড়ে গেছে। প্রথমে নগরবাসী মনে করেছিলেন ব্যাটারিচালিত রিকশা সস্তা ও পরিবেশবান্ধব বাহন হবে, কিন্তু এখন এটি নগরের জন্য এক প্রকার অভিশাপের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধু যানজট ও দুর্ঘটনা নয়, এসব রিকশা বিদ্যুৎ ব্যবহারে অনিয়মও করছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ব্যাটারিগুলো যেখানে-সেখানে ফেলা হচ্ছে, যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে।
সিলেট নগরী ও জেলাতে দিন দিন ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকারি অনুমোদন ছাড়া হাজার হাজার রিকশা রাস্তায় নামায় নগরজীবন এক প্রকার অচল হয়ে পড়েছে। যানজট, দুর্ঘটনা এবং বিশৃঙ্খলার মূল কারণ হিসেবে সাধারণ মানুষ এই ধরনের অবৈধ যানবাহনকে দায়ী করছেন।

সরেজিমনে দেখা গেছে, সিলেট নগরীর বিভিন্ন সড়কে অধিকাংশ রিকশাচালক অপ্রাপ্তবয়স্ক। হঠাৎ ইউটার্ন, উল্টো পথে চলাচল, হঠাৎ থেমে যাওয়া এবং দ্রুতগতিতে প্রতিযোগিতা—সব মিলিয়ে প্রতিদিন ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে।
সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকার ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক সালেক মিয়া জানান, “আমি সিটি কর্পোরেশন এলাকার ভোটার। পরিবার চালাতে আমাদের এই রিকশা চালাতে হয়। সরকারি অনুমোদন না থাকলেও জীবন চালাতে বাধ্য। যদি নির্ধারিত এলাকায় অনুমোদন দেওয়া হয়, তাহলে সরকারও উপকৃত হতো এবং আমাদের পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি করতে হতো না। প্রয়োজনে মূল সড়কের বদলে গলির রাস্তায় অনুমোদন দেওয়া হোক।”
আরেক চালক সালাম মিয়া বলেন, “আমরা শহরের নিরাপত্তা ও নিয়ম মেনে রিকশা চালাতে চাই। কিন্তু মালিকরা নতুন রিকশা যোগ করায় চাপ বাড়ছে। পুলিশের অভিযান হলে রিকশা জব্দ হয়, কয়েক দিনের মধ্যে আবার রাস্তায় চলে আসে। যদি নির্দিষ্ট এলাকায় অনুমোদন দেওয়া হয়, আমরা আইন মেনে উপার্জন করতে পারব।”
নগরীতে ব্যাটারিচালিত রিকশার অবৈধ চলাচল শুধু যানজট ও দুর্ঘটনার কারণ নয়, এটি নগর ব্যবস্থাপনাকেও অচল করে দিচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত রিকশার সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় পুলিশের জন্য নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। নিয়মিত অভিযান চালানো হলেও নতুন রিকশা রাস্তায় নামার কারণে সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধান হচ্ছে না।
সিলেট মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান জানান, সিলেটে অনেক অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা রাস্তায় চলাচল করছে। আনুমানিক সংখ্যা ১৫-২০ হাজার। নিয়মিত অভিযান চালিয়ে জব্দ করা হয়, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই আবার রাস্তায় চলে আসে। মাসে ১৫০০-এর বেশি রিকশা জব্দ হয়। তবে এগুলো ডাম্পিং কেন্দ্রে রাখাও ঝামেলার কারণ। ডাম্পিংয়ের জায়গা কম, এছাড়া ব্যাটারিগুলো দামি হওয়ায় চুরির সম্ভাবনা থাকে। স্থানীয় প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় মালিকরা নিয়মিত নতুন যান নামাচ্ছেন। মূল সড়কে উঠলেই ব্যবস্থা নিচ্ছি, তবে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জিং।
সিলেট নগরীর অবৈধ রিকশার চলাচল শুধু যানজট ও দুর্ঘটনার কারণ নয়, এটি বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও চাপ সৃষ্টি করছে। অনেক অবৈধ রিকশা বৈধ অনুমোদন ছাড়াই বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবহার করছে, যা বিদ্যুৎ সরবরাহকে প্রভাবিত করছে এবং দুর্ঘটনা ও বৈদ্যুতিক ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

ওজোপাডিকোর সিলেট বিভাগের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরাফাত বলেন, “সিলেট নগরীতে ব্যাটারিচালিত রিকশার পরিমাণ বেড়ে গেছে। তারা রিকশা চার্জ দিচ্ছে। আমাদের বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে চার্জিং স্টেশন করার সুযোগ নেই। ট্যারিফ রুলস অনুযায়ী অনুমোদন ছাড়া কেউ চার্জিং স্টেশন চালাতে পারবে না।”
তিনি আরও বলেন, “চার্জিং স্টেশনের ক্ষেত্রে শুধু আমাদের নজরদারি যথেষ্ট নয়, পুলিশ ও সিটি কর্পোরেশনের ভূমিকা প্রয়োজন। কেউ অবৈধভাবে চার্জিং স্টেশন চালালে বিদ্যুৎ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এদিকে সিলেট মহানগরীর সড়কগুলোতে ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে যানজট ও নিরাপদ চলাচলে ঝুঁকি বাড়ছে। সরকারি অনুমোদন ছাড়া রাস্তায় চলাচল করায় স্থানীয় বাসিন্দা ও পথচারীরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা শামীম আহমেদ বলেন, “ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে প্রতিদিন যানজট হয়। পথচারী ও স্কুলছাত্রদের হাঁটাহাঁটি কষ্টকর। যদি সিটি কর্পোরেশন ও পুলিশ এগুলো বন্ধ করে, জীবন অনেক সহজ হবে।”
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাই রাফিন সরকার জানান, “সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার কোনো স্বীকৃতি নেই। প্যাডেলচালিত রিকশার অনুমোদন আছে। সিটি কর্পোরেশন ও পুলিশ মিলে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছি। আগামী ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে পর্যায়ক্রমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। অনুমোদনহীন চার্জিং স্টেশনও বন্ধ করা হবে।”
সুনামগঞ্জ-
এক সময় হাওরের শহর সুনামগঞ্জকে শান্ত শহর বলা হতো। আজ তা পরিণত হয়েছে যানজট, দুর্ঘটনা ও বিদ্যুৎ সংকটের শহরে। প্রতিদিন সকাল-বিকেল নাগরিকদের সবচেয়ে বড় ভোগান্তি হচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক। মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের শহরে এখন চলাচল করছে কয়েক হাজার অটোরিকশা।
শহরের ট্রাফিক মোড়, হাসপাতাল রোড, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড ও নতুন ব্রিজ এলাকায় মানুষ সকাল-বিকেলে তীব্র যানজটে আটকে পড়ছে। অফিসগামী কর্মজীবী থেকে শুরু করে স্কুলের শিক্ষার্থী—সবার সময় নষ্ট হচ্ছে। অনেক সময় অ্যাম্বুলেন্সও আটকে যাচ্ছে।

সুনামগঞ্জে সস্তা ও সহজ যাতায়াতের জন্য ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এক সময় আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল, কিন্তু এখন এটি নাগরিক জীবনে মহাসংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। যানজট, দুর্ঘটনা ও বিদ্যুতের চাপ—এই ছোট শহরকে প্রতিদিন অস্থির করে তুলছে।
জেলা শ্রমিক ঐক্য পরিষদের তথ্যমতে, পুরো জেলায় ৭-৮ হাজার ইজিবাইক ও ১-১.৫ হাজার অটোরিকশা রয়েছে। সচেতন মহল বলছে, বাস্তবে সংখ্যা পাঁচ গুণেরও বেশি।
জেলা ইজিবাইক (অটো) মালিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি সুহেল আহমদ জানান, “শুধুমাত্র পৌর এলাকায় নিবন্ধন আছে। নিবন্ধিত ইজিবাইকের সংখ্যা ১৩০০, ব্যাটারিচালিত রিকশা প্রায় ১০০০। এর বাইরে কতগুলো চলছে, বলা মুশকিল।”
ইজিবাইক চালক আনোয়ার হোসেন বলেন, “৬০০ টাকা ভাড়া দিয়ে গাড়ি চালাই, কিন্তু অবৈধ গাড়িগুলো আমাদের রুটি-রুজি কেড়ে নিচ্ছে। প্রশাসনের উচিত এগুলো আটক করা।”
পথচারী তানভীর আহমেদ বলেন, “অবৈধ যানবাহন রাস্তায় চলাচল করছে, পুলিশ ধরলেও আবার ছেড়ে দেয়। কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা প্রয়োজন।”
মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, “রিকশা চালকদের প্রশিক্ষণ নেই, সিগন্যাল বোঝে না। হঠাৎ যাত্রী তুলতে গাড়ি থামালে জ্যাম হয়।”
সুনামগঞ্জ জেলা ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক মো. হানিফ মিয়া জানান, “৯৯ শতাংশ অটোরিকশা ও ইজিবাইকের নিবন্ধন আছে। সাবেক মেয়র মাদের বখত অবৈধ গাড়িগুলো বৈধ করেছিলেন। প্রায় ২৭০০ নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। শহরের জন্য এটি ক্যান্সারের মতো। বাইরে থেকে আসা অনিবন্ধিত যানবাহনের প্রবেশ বন্ধ করতে প্রতিদিন অভিযান চালাচ্ছি।”
বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের কন্ট্রোল রুম ইনচার্জ লোকমান হোসেন জানান, ব্যাটারিচালিত যানবাহনের চার্জে তেমন কোনো ঘাটতি নেই। তবে গ্রীষ্মকালে চাপ বেশি। অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
পৌরসভার প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, “শহরের রাস্তার তুলনায় রিকশার সংখ্যা অনেক বেশি। সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে অনেককে আটক করেছি। শহরে প্রবেশপথে নিয়ন্ত্রণ না করলে নাগরিকদের ভোগান্তি কমানো সম্ভব নয়।”

হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার-
এই দুই শহরেও একই সমস্যা বিরাজ করছে। গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও স্কুল-কলেজপথে প্রতিদিন ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। জেলা ট্রাফিক পুলিশ জানায়, নিবন্ধিত রিকশার তুলনায় অনিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা অনেক বেশি। প্রতিদিন অভিযান চালানো হলেও প্রবেশপথে নিয়ন্ত্রণ ছাড়া অবৈধ যানবাহন শহরে প্রবেশ করছে।
নাগরিক ও বিশেষজ্ঞদের দাবি-
নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশাকে প্রধান সড়ক থেকে সরানো উচিত। প্রয়োজনে অনুমোদিত ইলেকট্রিক রিকশা চালু করে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে বিভাগীয় শহরগুলোতে যানজট, দুর্ঘটনা ও জনদুর্ভোগ আরও বেড়ে যাবে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিচসা) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, “সিলেট নগরীতে ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপট ও অবৈধ চলাচল শহরের সড়ক নিরাপত্তার জন্য বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। অবৈধ রিকশাকে প্রধান সড়ক থেকে সরিয়ে বৈধ ও অনুমোদিত রিকশা চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে দুর্ঘটনা ও যানজট আরও বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া অবৈধ রিকশার উৎপাদন চিরতরে বন্ধ করতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। শিশু ও অপ্রাপ্তবয়স্করা রিকশা চালাচ্ছে, যা যাত্রী ও পথচারীর জন্য ভয়ঙ্কর। নাগরিক হিসেবে এ ধরনের যানবাহন বয়কট করতে হবে। প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।”

