বুয়েট থেকে বিশ্বমানের ইঞ্জিনিয়ার বের হয়। তবে দেশের বাস্তবতায় এই মেধা যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায় না। শুধু বুয়েট নয়, দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চমানের শিক্ষার্থীরাও প্রায় একই সমস্যার মুখোমুখি হয়। অনেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে চলে যায়, সেখানে নিজের শ্রম, মেধা, ধৈর্য্য এবং পরিবারের সাপোর্ট নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠিত ক্যারিয়ার গড়ে তোলে।
কিন্তু দেশে ফিরে এসে তাদের যোগ্যতা প্রয়োগের পথ প্রায়শই বন্ধ। উচ্চমানের গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, বাজেট, ল্যাব সুবিধা, আধুনিক প্রযুক্তি বা ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নেই। ফলে দেশের মেধাবী ছাত্ররা ঘরে বসে বা সরকারি চাকুরির পিছনে সময় নষ্ট করতে বাধ্য হয়।
একজন ভালো স্টুডেন্ট আন্ডারগ্র্যাজুয়েট করার পর কি করবে? যারা উচ্চমেধাবী, তারা উচ্চতর গবেষণার দিকে যেতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যা আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা বা পিএইচডি কার্যক্রম সম্পাদন করতে পারে। এটি কোন শিক্ষার্থীর দায় নয়। ভারতের ২৩টি আইআইটি স্থাপন এবং সেগুলোতে বিশ্বমানের পিএইচডি প্রদান করা সম্ভব হলেও- বাংলাদেশ ৫৪ বছরে দুটি মানসম্মত প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও তৈরি করতে পারেনি। এই পার্থক্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও নীতি গ্রহণে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার পরিচায়ক।
দেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্টুডেন্টরা যখন বিদেশে যায়, তখন তারা শুধুমাত্র পড়াশোনা করে না, নিজের শ্রম ও যোগ্যতা দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠিত ক্যারিয়ার গড়ে। দেশে ফিরে গেলে, তাদের জন্য কাজের পরিবেশ না থাকায়, অনেকেই হতাশ হয়। বুয়েটের অ্যালামনাইদের খোঁজ নেওয়া হয় না। কোনো ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম নেই এবং প্রশাসন বিদেশে গিয়ে মেধাবী ছাত্রদের খোঁজও নেয় না। এদিকে ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এমনকি পাকিস্তান নিয়মিতভাবে এমন প্রোগ্রাম পরিচালনা করে। বাংলাদেশে শত কোটি টাকার “অপচয় প্রজেক্ট” থাকলেও ন্যাশনাল ট্যালেন্ট হান্ট প্রকল্প বা প্রজেক্ট সাপোর্ট ব্যবস্থা নেই।
দেশের উচ্চশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়োগ প্রক্রিয়া অনেক সময় তাদের সুযোগ সংকুচিত করে। উদাহরণস্বরূপ, বিসিএস টেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাডারে শুধু বিএসসি ইঞ্জিনিয়াররাই নয়, ডিপ্লোমাধারীরাও নিয়োগ পায়। এর ফলে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য প্রবেশের সুযোগ কমে যায়। এটি দেশের মেধাবী ইঞ্জিনিয়ারদের প্রতি বৈষম্যের একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ।
কিছু মন্তব্য থেকে স্পষ্ট, যে মেধাবীরা সরকারি চাকুরির পিছনে ঝুঁকছে, তা সবসময়ই দেশের উন্নয়নে কাজে ব্যবহার হচ্ছে না। অনেকেই মনে করেন, যদি তারা সত্যিকারের দক্ষ হতো, তবে নিজ উদ্যোগে শিল্প, প্রযুক্তি বা গবেষণার মাধ্যমে দেশের জন্য কিছু করতে পারত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশে এমন একটি সাপোর্ট সিস্টেম নেই যা বিদেশ থেকে ফিরে আসা মেধাবীদের কাজে লাগাতে পারে।
শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার অভিজ্ঞতাও সমস্যামুক্ত নয়। দুইবারের বেশি ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ নেই। কোচিং খরচ, বয়সসীমা, সেশন জট—এসব কারণে শিক্ষার্থীরা বিড়ম্বনায় পড়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট সীমিত, শিক্ষক কম, রাজনীতি প্রাধান্য—এই সব কারণে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিছু ক্ষেত্রে বেশি সুযোগ দিচ্ছে, তবে সবার জন্য সমান নয়।
অপরদিকে, দেশে শিল্প ও প্রযুক্তি খাতে নতুন সেক্টর তৈরির ব্যবস্থা নেই। পদ্মা সেতু, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনার মতো বড় প্রকল্পে দেশীয় জনশক্তি তৈরি করা হয়নি। দেশের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেসিক প্রশিক্ষণ, জনশক্তি উন্নয়ন এবং বাস্তবায়নযোগ্য প্রশিক্ষণ নেই। বিদেশের অভিজ্ঞতা ও মেধা দেশে কাজে লাগানো বাধাপ্রাপ্ত। এমন পরিস্থিতিতে, মেধাবী ইঞ্জিনিয়াররা ঘরে বসে সরকারি চাকুরি বা অপ্রয়োজনীয় পদে আটকে থাকে।
নিজেরা উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব: দেশে উদ্যোক্তা হওয়া এবং নতুন উদ্যোগ শুরু করার পরিবেশ সীমিত। তবে যারা উদ্যোক্তা হতে চায়, তারা ক্ষুদ্রভাবে হলেও শিল্প, প্রযুক্তি বা স্টার্টআপের মাধ্যমে দেশের জন্য নতুন সেক্টর তৈরি করতে পারে। এটি করতে হলে সরকারী সহায়তা, বাজেট, প্রশিক্ষণ এবং আইনি সুবিধা থাকা জরুরি। বিদেশে যারা উচ্চমানের গবেষণা বা কাজ করেছেন, তারা দেশে ফিরে নিজ উদ্যোগে নতুন প্রতিষ্ঠান, ল্যাব বা স্টার্টআপ তৈরি করতে পারে। এমন উদ্যোগ দেশের প্রযুক্তি ও শিল্প খাতে নতুন দিশা দেখাবে এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করবে।
মোটকথা, দেশে মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার ও গবেষক তৈরি হয়, কিন্তু তাদের কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা নেই। রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে—উচ্চশিক্ষিত মানুষের জন্য সুযোগ, বাজেট, প্রশিক্ষণ এবং প্রজেক্ট সাপোর্ট নিশ্চিত করতে হবে। পলিসি মেকারদের দায়িত্ব হলো মেধা ধরে রাখা, প্রয়োগযোগ্য ব্যবস্থা তৈরি করা, যাতে দেশের প্রযুক্তি ও শিল্প খাতে উন্নয়ন থেমে না যায়। মানুষ তৈরি করা একটি বড় কাজ, কিন্তু তাদের ধরে রাখার ব্যবস্থা করা এবং উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করা তার চেয়ে আরও কঠিন এবং জরুরি।
উপরন্তু, দেশের মেধাবী শিক্ষার্থী ও ইঞ্জিনিয়ারদের প্রতি সাপোর্ট ব্যবস্থা না থাকলে, তারা বিদেশে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প দেখতে পায় না। এটি দেশের প্রযুক্তি, শিল্প ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি। সরকারের উচিত, দেশে ফিরতে চাওয়া উচ্চশিক্ষিত মানুষদের জন্য সহজ ও সমর্থনমুলক পরিবেশ তৈরি করা, যাতে তারা নিজের শ্রম ও যোগ্যতা দিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।