১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানে পতন ঘটে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের। তার আগের দিন, অর্থাৎ ৫ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পদত্যাগের পর সব দলের ঐকমত্যে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। ৯ ডিসেম্বর তিনি সেই সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নেন।
মাত্র ৭৮ দিনের মধ্যেই তিনি একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পন্ন করেন। পরে আওয়ামী লীগের আমলে ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন এবং টানা পাঁচ বছর এ পদে ছিলেন। বিশ্লেষকদের মতে, নিরপেক্ষতা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা ও প্রজ্ঞার কারণে নব্বই-পরবর্তী রাজনীতিতে তিনি আজীবন প্রাসঙ্গিক থেকেছেন এবং আজকের রাজনৈতিক সংকটেও তার ভূমিকা উদাহরণ হয়ে আছে।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন এরশাদ। পুরো দশক জুড়ে বিরোধী দলগুলো আন্দোলন চালিয়ে যায়। সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য ও তিন জোটের যৌথ আন্দোলনের মুখে এরশাদ ৪ ডিসেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দেন এবং ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা হস্তান্তর করেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের কাছে। তখন তিনি প্রতিশ্রুতি দেন তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করবেন এবং সেই অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু করেন।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ কিছু আইন সংশোধন করেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। তার নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সর্বমহলে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
তবে তখন একটি সাংবিধানিক জটিলতা দেখা দেয়। তিনি প্রধান বিচারপতির পদ ছাড়তে রাজি ছিলেন না এবং শর্ত দেন যে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি আবার প্রধান বিচারপতির পদে ফিরবেন। রাজনৈতিক দলগুলো তার শর্ত মেনে নেয়। সেই বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই ক্ষমতা হস্তান্তরের রূপরেখা চূড়ান্ত হয়। এরশাদের পদত্যাগের পর সাহাবুদ্দীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন এবং ১৯৯১ সালের অক্টোবরে প্রধান বিচারপতির পদে ফেরেন।
সেই সময়ের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেজর (অব.) মনজুর কাদের জানান, প্রধান বিচারপতির পদেই সাহাবুদ্দীনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। নিরপেক্ষতার জায়গা থেকে দলগুলো তাকে মেনে নেয়।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সাহাবুদ্দীন ছিলেন ক্ষমতালোভমুক্ত। তার লক্ষ্য ছিল কেবল একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন। সেই একমাত্র এজেন্ডাই তাকে সফল করে তোলে।
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। এরপর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সংবিধানের একাদশ সংশোধনী পাস হয়, যাতে সাহাবুদ্দীনের উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ এবং পরে প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যাওয়া বৈধতা পায়।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সাহাবুদ্দীন একটি সফল নির্বাচন করতে পেরেছিলেন কারণ তখনো প্রশাসন পুরোপুরি দলীয়করণ হয়নি। পাশাপাশি তিনি অল্প সময়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন এবং উপদেষ্টা কাউন্সিলকে শক্তিশালী করেন। ব্যক্তি হিসেবেও তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও পরিচ্ছন্ন।
১৯৯৫ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর নেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। পরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ তাকে রাষ্ট্রপতি পদে ফিরিয়ে আনে। সে সময় তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেন। এই মেয়াদে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হারের পর তাকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসর নেন।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আবদুল মতিন বলেন, সাহাবুদ্দীন সংকটকালে সাহসিকতা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের স্বার্থকে নিজের নিরাপত্তার ওপরে স্থান দিয়েছেন। তাই তার গ্রহণযোগ্যতা সর্বমহলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।