বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিয়োগে দীর্ঘদিন ধরেই যোগ্যতা, স্বজনপ্রীতি ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড যেখানে গবেষণার দক্ষতা ও পিএইচডি ডিগ্রিকে গুরুত্ব দেয়, সেখানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এখনো স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফলাফলের ওপর নির্ভরশীলতা দেখা যায়। নতুন নিয়োগ নীতিমালায় এ বৈপরীত্য আরো স্পষ্ট হয়েছে।
চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গত কয়েক দশকে বিশ্ব র্যাংকিংয়ে দৃশ্যমান সাফল্য অর্জন করেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডস (কিউএস) প্রতিবছর প্রকাশিত তালিকায় দেখা যায়, বিশ্বের সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চীনের পাঁচটি, সিঙ্গাপুরের দুটি এবং মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা করে নিয়েছে। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ১৫০-এর মধ্যে তিনটি অবস্থান ধরে রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই সেরা ৫০০-এর মধ্যে প্রবেশ করতে পারেনি।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বনাম বাংলাদেশি বাস্তবতা-
বিশ্ব র্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, শিক্ষক নিয়োগে গবেষণা ও শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতাকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেয়া হয়। ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে পিএইচডি ডিগ্রি অপরিহার্য ধরা হয়। যেমন—ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর, চীনের পিকিং ও সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি মালায়া কিংবা ভারতের আইআইটি দিল্লি ও আইআইটি মুম্বাই—সব জায়গাতেই প্রভাষক পদে আবেদন করার শর্ত হিসেবে পিএইচডি উল্লেখ আছে। শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হিসেবে বিশেষায়িত ট্রেনিংকে গ্রহণযোগ্য ধরা হয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই মানদণ্ড মানা হয়নি। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি নতুন নীতিমালা খসড়া করেছে। খসড়ায় দেখা যায়, প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ১০০ নম্বরের মধ্যে এসএসসিতে ৫, এইচএসসিতে ১০, অনার্সে ৪৫, মাস্টার্সে ২০ নম্বর রাখা হয়েছে। অথচ গবেষণা বা পিএইচডির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ৫ নম্বর—যা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার চেয়ে কম গুরুত্ব বহন করে।
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিনের অনিয়ম-
শুধু জাহাঙ্গীরনগর নয়, প্রায় সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই এ চিত্র। কোথাও নির্দিষ্ট মার্কিং ব্যবস্থা না থাকলেও পিএইচডিধারীদের উপেক্ষা করা হয়েছে বহু ক্ষেত্রে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের তথ্য অনুযায়ী গত ১৫ বছরে প্রায় ৮ হাজার ৮০০ শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বর্তমানে বিদ্যমান শিক্ষকদের অর্ধেকের বেশি এই সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত। স্বজনপ্রীতি, দলীয় বিবেচনা, শর্ত শিথিল কিংবা আর্থিক লেনদেন—এসব অভিযোগ ঘিরেই নিয়োগ প্রক্রিয়া হয়েছে বলে একাধিক রিপোর্টে উঠে এসেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০১৬ সালের এক প্রকাশনায় বলা হয়েছিল, প্রভাষক নিয়োগে দুর্নীতি ও দলীয়করণ এতটাই প্রভাবশালী যে, আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের বাস্তবতা-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী তুহিন ইসলাম বলেন, “আমাদের অনেক শিক্ষকই পড়াতে পারতেন না, প্রশ্ন করলে রেগে যেতেন এবং অনেক সময় পরীক্ষায় নম্বর কেটে দিতেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকায় তারা নিয়মিত ক্লাসও নিতেন না। নিয়োগে শর্ত শিথিল করেই তারা শিক্ষক হয়েছেন।”
তিনি মনে করেন, “যদি শিক্ষক নিয়োগ কঠোর মানদণ্ডে হতো এবং গবেষণাকে প্রাধান্য দেয়া হতো, তাহলে রাজনীতি দিয়ে নিয়োগ পাওয়া সম্ভব হতো না। শিক্ষকেরা পড়াশোনার চেয়ে রাজনীতিতে বেশি যুক্ত থাকতেন না।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আন্তর্জাতিক তুলনা-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রথম উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠিত ১৯২১ সালে। শত বছরের বেশি সময়ে দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ১৭১টি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। কিন্তু মানোন্নয়নে এগোতে পারেনি। কিউএস র্যাংকিংয়ে ঢাবির অবস্থান ২০২৫ সালে ৫৮৪তম, অথচ চীনের সমসাময়িক প্রতিষ্ঠিত সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় ১৭তম স্থানে।
সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণ শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে চাইলে শুধু পিএইচডিই নয়, অন্তত দুই বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাও থাকতে হয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগে এখনো প্রধানত একাডেমিক ফলাফলের ওপর নির্ভর করা হয়। সম্প্রতি উর্দু বিভাগে এমন এক প্রার্থীকে বাদ দেয়া হয় যিনি স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডিতে ভালো ফল করেছিলেন, কিন্তু এসএসসি-এইচএসসিতে তুলনামূলক কম নম্বর থাকায় বাদ পড়েন।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য-
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, “আগে কোনো নীতিমালা ছিল না। আমরা পরীক্ষামূলকভাবে এ খসড়া তৈরি করেছি। এতে পিএইচডিতে নম্বর কম রাখা হলেও ভবিষ্যতে সংশোধনের সুযোগ রয়েছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, “পিএইচডি থাকা গুরুত্বপূর্ণ, তবে আমরা গবেষণার মান ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশনাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। অনেক সময় মেধাবীরা মাস্টার্স শেষ করেই শিক্ষকতায় আসেন, যাতে তারা গবেষণার পথে অগ্রসর হতে পারেন। পরে আমরা তাদের পিএইচডি করতে উৎসাহিত করি।”
তিনি আরো যোগ করেন, “আমরা আন্তর্জাতিক যৌথ গবেষণা ও এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের সুযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে শিক্ষক নিয়োগে পিএইচডিকে আরো গুরুত্বপূর্ণ করা হবে। তবে এজন্য দেশের গবেষণা কাঠামো শক্তিশালী করাও জরুরি।”
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম বলেন, “শিক্ষকের দক্ষতার ওপরই নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কতটা দক্ষ হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ বড় সংকট তৈরি করেছে। বাজেট ঘাটতি থাকলেও প্রকৃত ক্ষতি হয়েছে অযোগ্য শিক্ষকতার কারণে।”
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এসএমএ ফয়েজ বলেন, “পিএইচডিধারী শিক্ষকদের অবশ্যই অগ্রাধিকার দেয়া হয়। অনেক সময় তারা সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসেবেও নিয়োগ পান। তবে নম্বর বণ্টনে পিএইচডিকে ৫ নম্বর দেয়া যৌক্তিক নয়। আমরা গবেষণা ফান্ডিং ও উৎসাহমূলক উদ্যোগ নিচ্ছি, যাতে মানোন্নয়ন সম্ভব হয়।”
সংকটের সারমর্ম-
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পিএইচডি ও গবেষণার মানকে অগ্রাধিকার না দিলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়েই থাকবে। যখন প্রতিবেশী দেশগুলো র্যাংকিংয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সেরা ৫০০-তেও নেই। এর মূল কারণ—দুর্বল নিয়োগ ব্যবস্থা, স্বজনপ্রীতি এবং গবেষণার অবমূল্যায়ন।
দীর্ঘমেয়াদে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষক তৈরি না হলে এবং স্বচ্ছ নিয়োগব্যবস্থা গড়ে না উঠলে বিশ্ব র্যাংকিংয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাই শিক্ষক নিয়োগে সংস্কার এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।