কোভিড-১৯ মহামারির সময় বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ স্থাপনে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করা হয়েছিল। সরকারের ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্পের আওতায় ৪৮ জেলায় ১০ শয্যার আইসিইউ স্থাপনে মোট ৫১২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে অন্তত ১২ জেলা হাসপাতালে এসব ইউনিট বন্ধ রয়েছে। এতে প্রায় ১২০ কোটি টাকার সরঞ্জাম মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।
২০২০ সালের এপ্রিল মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সারাদেশে কার্যকর আইসিইউ ইউনিটের সংখ্যা তখন মাত্র ১১২টি। পরবর্তী সময়ে আইসিইউ বেডের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ৭৪টি সরকারি হাসপাতালে মোট ১,৩৭২টি আইসিইউ বেড রয়েছে, যার ৫৫ শতাংশই ঢাকায়।
অকার্যকর আইসিইউ ইউনিটের তালিকায় রয়েছে—সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতাল, যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল, সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যা হাসপাতাল এবং চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. আলমগীর হোসেন বলেন, “আমাদের আইসিইউ জনবল সংকটের কারণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে। শিগগিরই চালু করার প্রক্রিয়া শুরু হবে।”
মহামারির সময় নতুন আইসিইউ চালাতে অস্থায়ীভাবে এক হাজারের বেশি চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তবে তাদের চুক্তি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হওয়ার পর নবায়ন করা হয়নি। ফলে অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও অনেক হাসপাতাল পূর্ণ সক্ষমতায় আইসিইউ চালাতে পারছে না। স্বাস্থ্য সচিব সাইদুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, “অনেক আইসিইউ এখনও অকার্যকর। বিভিন্ন জেলায় অবকাঠামো থাকলেও সেগুলো চালু হয়নি। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রকল্পের আওতায় এগুলো সচল করার কাজ চলছে।”
তিনি আরও বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে দেশে অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ এবং প্রশিক্ষিত নার্সের অভাব রয়েছে। বর্তমান জনবল দিয়ে চাহিদা পূরণ করা কঠিন। সম্প্রতি অ্যানেসথেসিয়ার খাতে বেতন বাড়ানো হয়েছে, যাতে আরও বেশি চিকিৎসক আকৃষ্ট হন।”
অত্যাধুনিক আইসিইউও অচল-
জনবল সংকট শুধু জেলা পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়। তিন বছর আগে উদ্বোধন হওয়া বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের ১০০ শয্যার আইসিইউ ইউনিটও এখনও পুরোপুরি চালু হয়নি। দুই মাস আগে সেখানে ২০ শয্যার আইসিইউ চালু হলেও বাকি ৮০ শয্যা এখনো বন্ধ রয়েছে।
বিএমইউর অ্যানেসথেসিয়া, অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুস্তাফা কামাল বলেন, “জনবল সংকটের কারণে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে ২০ শয্যার জেনারেল আইসিইউ চালাতে পারছি না। শিগগিরই আরও শয্যা চালুর চেষ্টা করা হবে, এতে চাপ কিছুটা কমবে।” তিনি জানান, বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ বছরে মাত্র ১৫০–২০০ জন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ তৈরি হয়।
অধ্যাপক মুস্তাফা কামাল বলেন, “অ্যানেসথেসিয়ায় উচ্চতর ডিগ্রি নিতে আগ্রহী কম, কারণ এখানে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ সীমিত। আইসিইউতে কাজের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত নার্স প্রয়োজন, কিন্তু দীর্ঘ কর্মঘণ্টা এবং সীমিত প্রণোদনার কারণে অনেকেই এ দায়িত্ব নিতে চান না।” তিনি প্রস্তাব করেন, “আইসিইউ চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য বিশেষ ভাতা চালু করা উচিত। এতে চিকিৎসকরা ক্রিটিক্যাল কেয়ারে বিশেষায়িত হতে উৎসাহিত হবেন এবং নার্সরাও আইসিইউ দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হবেন।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে দেশে মোট ১,৫৭৫ জন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট আছেন। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত পদগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশই শূন্য।
রোগীরা আইসিইউ বেড খুঁজে হাহাকার-
জনবল সংকটের প্রভাব রোগীদের ওপর তীব্র। ভোলার মোসারফ হোসেন (৫৪) ৩ সেপ্টেম্বর স্ট্রোক করেন। ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সে স্থান না পেয়ে পরিবার বারডেম হাসপাতালে ছয় দিনে ২ লাখ টাকা খরচ করে বেড পান। এরপর বিএমইউতে দুই দিন অপেক্ষার পর ভর্তি হয়।
কিন্তু সব রোগীর ভাগ্য এত শুভ নয়। শ্যামলী ২৫০ শয্যা টিবি হাসপাতালে মোহাম্মদ খালেদ আইসিইউ খুঁজতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত বেড না পেয়ে মারা যান। বিএমইউতে প্রতিদিন প্রায় ২৫টি আইসিইউ আবেদনের মধ্যে মাত্র ৩–৫ জন ভর্তি করা যায়। অধ্যাপক মুস্তাফা কামাল বলেন, “জরুরি ও অস্ত্রোপচার-পরবর্তী রোগীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বেসরকারি হাসপাতালে খরচ ৭০–৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।”
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২০ শয্যার আইসিইউ ও ১০ শয্যার এইচডিইউতে প্রতিদিন ২০–৩০টি আবেদন আসে। অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ডা. আসাদুল মাজিদ নোমান বলেন, “জনবল সংকট ভয়াবহ। ১৫ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য।”
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একসঙ্গে ৪,০০০ রোগী চিকিৎসাধীন। প্রতিদিন ৫০–৬০ জন আইসিইউর আবেদন করেন। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, “আমরা দৈনিক মাত্র ৩–৪ জনকে আইসিইউ বেড দিতে পারি।”
চিকিৎসকেরা বলছেন, জনবল সংকট সমাধান না হলে আইসিইউর অবকাঠামো অচল অবস্থায় পড়ে থাকবে এবং রোগীরা যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাবেন। অধ্যাপক মুস্তাফা কামাল বলেন, “কোভিড-১৯-এর পর সরকার বড় বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু দক্ষ জনবল ছাড়া রোগীদের দুর্ভোগ কমানো সম্ভব নয়। বিষয়টা শুধু বেড ও মেশিনের নয়, এগুলো চালানোর জন্য জনশক্তি তৈরি করাও জরুরি।”