কক্সবাজারের ভয়াবহ ভিড় ও পরিবেশগত চাপ কমাতে বাংলাদেশের সরকার রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তর করার উদ্যোগ নেয়। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল উন্নত বাসস্থান, নিরাপত্তা এবং মৌলিক সেবা নিশ্চিত করা। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা ও মাঠপর্যায়ের তথ্য ভিন্ন চিত্র উন্মোচিত করেছে।
পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি, খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা, স্বাস্থ্যঝুঁকি, কর্মসংস্থান সংকট এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জীবন কক্সবাজারের তুলনায় আরো জটিল এবং ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। প্রতি শরণার্থীর ভরণপোষণ খরচ কক্সবাজারের প্রায় তিন গুণ হওয়ায় এই মডেলের অর্থনৈতিক টেকসইতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর আদৌ সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে পতিত আওয়ামী লীগের আমলে সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয় করে। প্রকল্পটি ১৩ হাজার একর আয়তনের ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গার বসবাসের জন্য ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করে। এতে থাকা সুবিধার মধ্যে রয়েছে বাসস্থান, বিদ্যুৎ, সড়ক, বাঁধ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা।
বিশ্বব্যাংকের ‘বিয়ন্ড ক্যাম্পস অ্যান্ড কমিউনিটিজ: দি ইকোনমিকস অব রিফিউজি রিলোকেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাসানচরে প্রত্যেক রোহিঙ্গার বার্ষিক পরিচালন ব্যয় ১,৩৫০ থেকে ১,৮১০ মার্কিন ডলার, যা কক্সবাজারের ৪৩০ থেকে ৫৮০ ডলারের প্রায় তিন গুণ। দ্বীপের দূরত্ব এবং অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের অতিরিক্ত খরচই এর প্রধান কারণ। খাদ্য সহায়তায় একজন রোহিঙ্গার জন্য বার্ষিক খরচ ৪৭০ থেকে ৫৬৫ ডলার, যেখানে কক্সবাজারে এর পরিমাণ মাত্র ১৫০ থেকে ১৮০ ডলার। আশ্রয় ও সুরক্ষার খরচও ভাসানচরে বহুগুণ বেশি।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, কক্সবাজারে অতি ভিড়, অনিরাপদ অবকাঠামো এবং সীমিত সেবা থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা স্থানীয় অর্থনীতি ও সামাজিক যোগাযোগের সঙ্গে যুক্ত থেকে জীবনযাপন করতে পারছিল। কিন্তু ২০২০ সাল থেকে ধাপে ধাপে তাদের একটি অংশকে ৬০ কিলোমিটার দূরের ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়। দ্বীপটি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন এবং বাজার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংযুক্ত নয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভাসানচরে স্থানান্তরিত পরিবারগুলোর অবস্থা কক্সবাজারের পরিবারের তুলনায় অনেক খারাপ। তাদের গড় খাদ্য গ্রহণের মান ৪৪ শতাংশ কমে গেছে, খাদ্যের বৈচিত্র্য ৩৭ শতাংশ কমেছে এবং প্রতিদিনের খাদ্য গ্রহণের হার প্রায় ৪৭ শতাংশ কমে গেছে। মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যও অবনতির দিকে গেছে। মাঝারি থেকে গুরুতর বিষণ্নতায় আক্রান্তের হার বেড়েছে ৬.২ শতাংশ এবং শারীরিক অসুস্থতার হার ১৭ শতাংশ বেশি।
কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও ভাসানচরে থাকা রোহিঙ্গারা পিছিয়ে। কর্মরতদের মাসিক মজুরি কক্সবাজারের তুলনায় গড়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ কম। সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও বড় পার্থক্য দেখা গেছে। ভাসানচরে খাদ্য সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা ২৮ শতাংশ কম এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পাওয়ার হার ৩৮ শতাংশ কমে গেছে।
বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব সমস্যার মূল কারণ হলো ভাসানচরের ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা। প্রধান ভূখণ্ড থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে কোনো স্থানীয় জনবসতি ছাড়া দ্বীপে বাজার, শ্রমবাজার বা সরবরাহ চেইন গড়ে ওঠেনি। পুরোপুরি বাইরের লজিস্টিকস ও সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় সেবা প্রদানে, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এবং পণ্য সরবরাহে বড় সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে।
অবকাঠামো নির্মাণেও সরকারের এককালীন বিনিয়োগ নজিরবিহীন। ঘরবাড়ি, সড়ক, বাঁধ, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য স্থাপনায় প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য খরচ হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ডলার। ছোট জনসংখ্যার কারণে খরচ ভাগাভাগি বা কমানোর সুযোগ পাওয়া যায়নি। ফলে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য খরচ বহুগুণ বেড়ে গেছে।

ভাসানচর রিলোকেশন মডেল টেকসই সমাধান হিসেবে কার্যকর কিনা তা নতুন করে প্রশ্নের মুখে এসেছে। বিভিন্ন সূচকে দেখা যাচ্ছে পুষ্টি, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সহায়তা প্রাপ্তি—সব ক্ষেত্রে স্থানান্তরিত শরণার্থীদের উন্নতি হয়নি, বরং খারাপের দিকে গেছে। মানবিক সহায়তার সীমিত সম্পদের প্রেক্ষাপটে ব্যয়সাপেক্ষ উদ্যোগটি আর্থিকভাবে কার্যকর নয়। ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা এবং অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা ভাসানচরের কাঠামোগত সীমাবদ্ধতাকে আরও প্রকট করেছে। সব মিলিয়ে প্রমাণগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, দূরবর্তী দ্বীপে স্থানান্তর মানবিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্যর্থ এবং এর ধারাবাহিকতা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের সময় জাতিসংঘের একাধিক সংস্থা এবং ৫০টির বেশি আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় এনজিও কার্যক্রমে যুক্ত হয়। যদিও শুরুতে বাংলাদেশ সরকার ও নৌবাহিনী এককভাবে স্থানান্তর কার্যক্রম পরিচালনা করে। ১৯৯২ সালে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার জন্য।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ওই সময় সিদ্ধান্ত নেয়ার বাস্তবতা এবং বর্তমান বাস্তবতা এক নয়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের বিশ্লেষণ ছাড়া মন্তব্য করা ঠিক হবে না।”
তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলেন, ব্যয় বিবেচনায় সিদ্ধান্তটি আদৌ ভালো ছিল না। এটি ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সে সময়ে বাংলাদেশ সরকারের মনোভাব ছিল জাতিসংঘকে নিজের সক্ষমতা প্রদর্শন করা। প্রাথমিকভাবে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তহবিল সংকটের কারণে তা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। প্রথম দিকে স্থানান্তরের পরে অনেকেই ভাসানচর থেকে পালানোর চেষ্টা করেছে। অব্যবস্থাপনার বিষয়টি এরপর প্রকট হয়ে ওঠে।
শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, “ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল বলে মনে করি না। শুধুমাত্র ভৌগোলিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নযোগ্য (feasibility) দেখে এটি নেওয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালে যে বড় ইনফ্লাক্সটি ঘটেছিল, তা গভীর বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত ছিল। হয়তো জনমত তৈরি করার উদ্দেশ্যও কাজ করেছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর প্রয়োজন ছিল। ৪০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা সমুদ্রতীরে বিক্ষিপ্তভাবে বাস শুরু করলে মাদকপাচার নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে যেত। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় এটি কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। স্থানান্তরের ফলে ওই অঞ্চলে মাদক চোরাচালান কমে এসেছে।”
সব মিলিয়ে, ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর কার্যক্রম মানবিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে টেকসই হয়েছে কি না তা নিয়ে বিতর্ক এখনও চলমান। কক্সবাজারের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যয়, সীমিত কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এই মডেলের দীর্ঘমেয়াদি সফলতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

