বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ একটি দেশ। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই এখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। প্রতিবছর একাধিক ভূমিকম্প ঘটে, যেগুলোর কম্পন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুভূত হয়। আগে এই ভূমিকম্পগুলোর বেশিরভাগই পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশে অনুভূত হতো। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের ভেতরেই উৎপত্তিস্থল ভূমিকম্প বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে।
রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) সিলেট ও আশপাশের এলাকায় রিখটার স্কেলে ৪ মাত্রার একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। যদিও এতে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি, তবুও কম্পনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন স্থানীয় বাসিন্দারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হালকা মাত্রার এসব ভূমিকম্পকে হেলাফেলা করার সুযোগ নেই। কারণ অনেক সময় ছোট ছোট ভূমিকম্পই বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হয়ে দাঁড়ায়।
এক বছরের পরিসংখ্যান
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট ১২৬টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৮টির উৎপত্তি হয়েছে দেশের ভেতরেই।
শুধু ২০২৪ সালেই দেশে ১২টি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয়টি ভূমিকম্প হয়েছে। গত এক বছরে (২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) দেশে মোট ১০টি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে।
কোন এলাকায় সবচেয়ে বেশি
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের ভেতর থেকে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে সিলেটই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। গত এক বছরে এখানে আটটি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে।
এ ছাড়া দিনাজপুরে দুটি, রংপুরে দুটি, পাবনায় একটি, কুমিল্লায় একটি, শরীয়তপুরে একটি, টাঙ্গাইলে একটি, রাঙ্গামাটিতে একটি এবং চুয়াডাঙ্গায় একটি ভূমিকম্প হয়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পটি ঘটে ২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর শরীয়তপুর জেলার জাজিরায়। ঢাকা থেকে প্রায় ৪৮ কিলোমিটার দূরে হওয়া এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ১।
কেন ঝুঁকি বাড়ছে
ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবাইয়াত কবীর বলেন, বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এই অঞ্চল দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এখানে একটি প্লেট অন্যটির নিচে সরে যাচ্ছে বা সাবডাক্ট হচ্ছে। ফলে ভূত্বকের ভেতরে প্রচুর চাপ তৈরি হয়।
তিনি আরও জানান, এ অঞ্চলে অসংখ্য ফল্ট লাইন বা ভাঙন রেখা রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি বড় এবং সক্রিয়। এগুলো থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্প সৃষ্টির সম্ভাবনা সবসময় থাকে। ইতিহাসেও এ অঞ্চলে একাধিক শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছে।
বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা
রুবাইয়াত কবীর বলেন, “আমরা যেহেতু ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে আছি, যে কোনো সময় বড় ভূমিকম্প হতে পারে। তবে কবে হবে সেটা আগে থেকে বলা সম্ভব নয়। ছোট ছোট ভূমিকম্পগুলো হচ্ছে বলে এখনই বড় ভূমিকম্প হবে—এমন নয়। তবে ভূমিকম্প বিভিন্ন মাত্রায় ঘটতে থাকবে, এটা স্বাভাবিক।”
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের মতে, ছোট ছোট ভূমিকম্প মাঝে মাঝে বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হতে পারে। আবার নিয়মিতভাবে ছোট মাত্রার ভূমিকম্প হলে তা ভূত্বকের ভেতরে জমে থাকা চাপ বা শক্তি ধীরে ধীরে মুক্ত করে দেয়। এতে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি কিছুটা কমে যায়। তবে তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ভূমিকম্পের সঠিক মাত্রা বা সময় আগে থেকে বলা এখনো সম্ভব নয়। তাই প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
নগরায়ণ ও ঝুঁকি
বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেন, বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ণ, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ ও জনসংখ্যার ঘনত্ব ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। এখানে বড় কোনো ভূমিকম্প হলে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা ভয়াবহ হতে পারে।
তাদের মতে, ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে সচেতনতা বৃদ্ধি, ভবন নির্মাণে কোড মেনে চলা এবং জরুরি প্রস্তুতি পরিকল্পনা থাকা অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ—এটি এখন আর বিতর্কিত নয়। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ও বিশেষজ্ঞ মতামত বলছে, অভ্যন্তরীণ উৎপত্তির ভূমিকম্প বাড়ছে, যা নতুন করে সতর্কবার্তা দিচ্ছে। যদিও বড় ভূমিকম্প কবে হবে তা কেউ বলতে পারে না, তবে ঝুঁকিতে থাকার বিষয়টি স্পষ্ট। তাই আগাম প্রস্তুতিই এখন সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ।
ভূতাত্ত্বিক কারণে বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প অনিবার্য
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে, এ দেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকি থেকে কখনোই সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। বরং বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে এখানে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা সবসময় বিদ্যমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসাইন ভূইয়া দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে গবেষণা করছেন। তার মতে, ভূমিকম্প আমাদের জন্য কেবল সম্ভাবনা নয় বরং একপ্রকার অনিবার্য বাস্তবতা।
অধ্যাপক আনোয়ার বলেন, বাংলাদেশ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলের খুব কাছাকাছি অবস্থিত। এগুলো হলো ইন্ডিয়ান প্লেট, বার্মিজ প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেট। পৃথিবীর ভূত্বক আসলে স্থির নয়, বরং এসব প্লেট সবসময় ধীরে ধীরে নড়াচড়া করে। যখন এ নড়াচড়ার ফলে চাপ সৃষ্টি হয় এবং হঠাৎ করে তা মুক্তি পায়, তখনই ভূমিকম্প ঘটে। যেহেতু বাংলাদেশ এই প্লেটগুলোর সংঘর্ষমুখী অঞ্চলে রয়েছে, তাই ভূমিকম্প এখানে অবশ্যম্ভাবী।
কেন বাংলাদেশে ক্ষতি বেশি হয়
ভূমিকম্প শুধু কোথায় হচ্ছে তাই নয়, কী ধরনের ভূগঠনে তা ঘটছে, সেটিও বড় বিষয়। বাংলাদেশের ভূগঠন মূলত নরম শিলা ও পলিমাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ ধরনের মাটিতে কম্পনের মাত্রা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ সময় স্থায়ী হয়। ফলে নিম্ন ফ্রিকোয়েন্সি ও উচ্চ অ্যাম্পলিচিউডের ভূমিকম্প হলে ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি হয়।
অধ্যাপক আনোয়ার ব্যাখ্যা করেন, যখন মাটির নিজস্ব কম্পাঙ্ক ভবনের কম্পাঙ্কের সঙ্গে মিলে যায়, তখন তা মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনে। একে বলা হয় ‘রেজোন্যান্স’। এই পরিস্থিতিতে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও অনেক বড় ক্ষতি করতে পারে।
ছোট ছোট ভূমিকম্প স্বাভাবিক ঘটনা
তিনি বলেন, ছোট ছোট ভূমিকম্প প্রতিনিয়ত ঘটছে, যা আসলে একেবারেই স্বাভাবিক। পৃথিবীতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০টি ক্ষুদ্র ভূমিকম্প হয়। সাধারণত এক থেকে তিন মাত্রার ভূমিকম্প মানুষ টের পায় না। তবে চার মাত্রা বা তার ওপরে হলে তা অনুভূত হয় এবং ক্ষতির আশঙ্কাও তৈরি হয়। এসব ছোট ভূমিকম্পকে অনেক বিশেষজ্ঞ বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হিসেবেও দেখেন। কারণ এভাবে জমে থাকা চাপ ধীরে ধীরে বের হতে পারে, আবার অনেক সময় এ ছোট ছোট কম্পন বড় বিপর্যয়ের পূর্বঘোষণাও হয়ে ওঠে।
রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতির ঘাটতি
ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতিতে। অধ্যাপক আনোয়ারের মতে, সচেতনতা, পূর্বপ্রস্তুতি এবং কঠোর নিয়মকানুন মেনে চলাই ক্ষয়ক্ষতি কমানোর মূল উপায়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক সময় বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করা হয় না। নিয়ম অনুযায়ী ভূমিকম্প প্রতিরোধী নকশা ব্যবহার করা হলেও বাস্তবে তা মানা হয় খুবই কম। এতে ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। তিনি পরামর্শ দেন, প্রতিটি ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড বাধ্যতামূলক করতে হবে। খোলা জায়গা রাখতে হবে যাতে বিপর্যয়ের সময় উদ্ধারকাজ সহজ হয়।
এ ছাড়া যথেষ্ট চিকিৎসা ও উদ্ধার সরঞ্জাম আগে থেকেই প্রস্তুত রাখতে হবে। জরুরি মুহূর্তে ডাক্তার, নার্স ও উদ্ধারকর্মীরা যেন দ্রুত কাজ করতে পারে, সেজন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। সরকারি সংস্থা, গবেষক, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবক—সবাই মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করলে বড় ধরনের বিপর্যয়ও অনেকাংশে মোকাবিলা করা সম্ভব।
কেন এখনই উদ্যোগ জরুরি
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভূমিকম্পপ্রবণ এ অঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়ন ও নগরায়ণ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। কিন্তু নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে। যদি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মানা না হয়, তবে ভবিষ্যতে একটি বড় ভূমিকম্প পুরো দেশকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
তাদের মতে, দুর্যোগ ঠেকানো না গেলেও ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। এজন্য সঠিক পরিকল্পনা, কার্যকর আইন প্রয়োগ, গণসচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণভিত্তিক প্রস্তুতি অপরিহার্য। ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে এখন থেকেই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে ফেলতে হবে।