ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৫৬টি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। তবে কার্যক্রম চালু আছে খুব অল্প কয়েকটির। বহু কেন্দ্র কেবল কাগজে-কলমে টিকে আছে, কোনো কোনো কেন্দ্রের ‘ঠিকানা’ আসলে পরিচালকের কক্ষ, আর অধিকাংশ কেন্দ্রই অর্থ, যন্ত্রপাতি ও জনবল সংকটে।
মাইক্রোচিপকে প্রায়ই ‘নতুন তেল’ বলা হয়—যে খাত ২১শ শতাব্দীকে সংজ্ঞায়িত করতে পারে। বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর বাজার ২০৩০ সালের মধ্যে এক ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন ২০৩০ সালের মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারের চিপ ও ডিভাইস রপ্তানির রোডম্যাপ প্রকাশ করেছে। তবে সে লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন হবে সেমিকন্ডাক্টর নকশায় দক্ষ ১০ হাজার প্রকৌশলী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুলতান আহমেদ এই সম্ভাবনা অনেক আগেই দেখেছিলেন বলে জানালেন অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন।
তাঁর ভাষায়, “তিনি ৩০ বছর আগে সেমিকন্ডাক্টরের বিশ্বব্যাপী সম্ভাবনা বুঝতে পেরেছিলেন এবং ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেমিকন্ডাক্টর গবেষণা কেন্দ্র। সেই সময়ে শব্দটাই যখন অচেনা, তখন এমন একটি কেন্দ্র গড়ার কথা ভাবা ছিল সত্যিই দূরদর্শিতা।”
যদি সে কেন্দ্র পর্যাপ্ত অর্থ, যন্ত্রপাতি, পোস্ট-ডক ও পিএইচডি ফেলো এবং একজন পূর্ণকালীন পরিচালক পেত, তবে গত চার দশকে হাজারো দক্ষ প্রকৌশলী তৈরি হতে পারত। কিন্তু এ অভাবই যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ গবেষণা কেন্দ্রের বাস্তবতা।
অ্যারবারি কালচার থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তন, স্ট্র্যাটেজিক এইচআরএম থেকে মহাসাগর শাসন, নিউরোসায়েন্স থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ ৫৬টি গবেষণা কেন্দ্র থাকলেও সক্রিয় খুব কম।
অনেক কেন্দ্র কেবল নামেই আছে, কোনো কোনো কেন্দ্র পরিচালকের কক্ষকেই ব্যবহার করে তাদের ‘ঠিকানা’ হিসেবে, আর বেশিরভাগই অর্থ, যন্ত্রপাতি ও জনবল সংকটে ভুগছে।
নাম আছে, কাজ নেই: বোস সেন্টার-
সম্প্রতি বোস সেন্টারের পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন অধ্যাপক মামুন। নিবেদিত গবেষকদের কাছে এ পদ মর্যাদার হলেও তিনি পদত্যাগ করেছেন কারণ তিনি কোনো বৌদ্ধিক চ্যালেঞ্জ খুঁজে পাননি।
তিনি বলেন, “বোস সেন্টারের বয়স ৫১ বছর। এর আউটপুট কী? প্রথমেই দেখি এর অবস্থা: বিজ্ঞান কর্মশালার এক কামরার অফিস, দুজন কর্মচারী আর একজন পরিচালক। পরিচালকের প্রধান কাজ হলো ফেলোশিপ চেক বিতরণ আর ফাইল সই করা। কোনো পোস্ট-ডক নেই, কোনো পিএইচডি ফেলো নেই, নিজেদের কোনো গবেষকও নেই।
তিনি আরো বলেন, ফেলোশিপ পাওয়া শিক্ষকরা তাদের নিজ নিজ বিভাগেই গবেষণা করেন। কার্যত কেন্দ্রটি অর্থ বিতরণ ছাড়া আর কিছু করে না—যা সহজেই রেজিস্ট্রার অফিস করতে পারে। তাহলে সত্যেন্দ্রনাথ বোসের নামে এমন একটি কেন্দ্র রাখার মানেটা কী?”
পদে আসার পর তিনি কেন্দ্রকে পুনর্জীবিত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কারণ ১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালীন সত্যেন্দ্রনাথ বোস কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিকস আবিষ্কার করে আইনস্টাইনকে বিস্মিত করেছিলেন। তাঁর সেই তত্ত্বই তৈরি করে দিয়েছিল বোস-আইনস্টাইন কাঠামোর ভিত্তি।
কিন্তু কলকাতার এসএন বোস সেন্টারের মতো আধুনিক সুযোগসুবিধার পরিবেশ গড়ে ওঠেনি ঢাকায়। নিজের সংস্কার পরিকল্পনা জমা দিলেও অধিকাংশ প্রস্তাব উপেক্ষিত বা ভুলভাবে বোঝা হয়েছে। রাজনীতি আর গোষ্ঠীবাদ সবসময় একাডেমিক স্বার্থের আগে প্রাধান্য পায়। হতাশ হয়ে তিনি পদত্যাগ করেন।
অধিকাংশ কেন্দ্রের নেই আলাদা জায়গাও-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৬ কেন্দ্রের মধ্যে সক্রিয় দশটিরও কম। অথচ প্রত্যেকটি কেন্দ্র বরাদ্দ পায়। একাডেমিক চাহিদার চেয়ে ব্যক্তিগত লাভ আর ভোটভিত্তিক রাজনীতিই কেন্দ্র বৃদ্ধির কারণ।
অধ্যাপক মামুনের মতে, “অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজে গবেষণা কেন্দ্রগুলো স্বাধীনভাবে চলে। আমাদের এখানে তা হয় না। গবেষণা কেন্দ্রকে রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহার করা অপরাধ হিসেবে দেখা উচিত। গবেষণা জাতীয় উন্নয়নের মেরুদণ্ড।”
তাঁর মতে, গবেষণার জন্য পূর্ণাঙ্গ ইকোসিস্টেম দরকার—সুবিধা, নেটওয়ার্ক ও বৌদ্ধিক আদান-প্রদান। এ অভাবেই গত বছর দেশের ১৭ হাজার শিক্ষক-শিক্ষার্থী বিদেশে চলে গেছেন। অধিকাংশ কেন্দ্রের নেই যন্ত্রপাতি, কিছু কেন্দ্রের নেই এমনকি কক্ষও, বাজেটও নগণ্য। এক লাখ টাকার প্রকল্প থেকে কী ফল আশা করা যায়?
ক্রোমোজোম সেন্টার ও পাকিস্তানের শিক্ষা-
২০১৪ সালে অধ্যাপক শেখ শামিম উল আলমের উদ্যোগে চালু হওয়া ক্রোমোজোম সেন্টারের নিজস্ব কোনো ভবন নেই—পরিচালকের অফিসই এর ‘ঠিকানা’।
চলতি বছরে কেন্দ্রটি ১২ লাখ টাকা পেয়েছে, যার মধ্যে বেতন ও অন্যান্য খরচ বাদ দিলে গবেষণায় থাকে ৮ লাখ। সাধারণত চারজন তরুণ শিক্ষক প্রত্যেকে দুই লাখ টাকা করে পান, যা একাধিক রিভিউয়ের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়।
প্রথমে ক্রোমোজোমের আকার ও সংখ্যা নিয়ে কাজ শুরু হলেও পরে তা ডিএনএ, প্রোটিন, জিনোম সিকোয়েন্সিং ও জিন ট্রান্সফার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
বর্তমান পরিচালক ড. মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, যিনি সুইডেনে পোস্ট-ডক করেছেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনা টেনে বলেন, “সুইডেনে থাকার সময় আমার পাকিস্তানি সহকর্মীরা জানাতেন, মুশাররফ আমলে সরকারি অর্থে বিদেশে পড়াশোনা করলে দেশে ফিরে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে হতো, আর সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হতো। না ফিরলে বিনিয়োগের পাঁচগুণ ফেরত দিতে হতো। গবেষণা না করলে বেতন কাটা যেত। আমাদের দেশে উল্টো—মেধাবীদের যেন বিদেশে ঠেলে দিই।”
তিনি আরো জানান, তহবিল পেলেও বিলম্বিত অর্থ ছাড়ের কারণে গবেষণার মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বায়োটেকনোলজি গবেষণার খরচ বিশাল—এনজাইম আমদানি করতে হয়, শুল্ক যোগ হয়। তবুও ক্রোমোজোম সেন্টার অন্য অনেক কেন্দ্রের চেয়ে সক্রিয়।
তবে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে তুলনা করতে বললে তিনি স্বীকার করেন, “তুলনার কোনো ভিত্তি নেই।”
ফুলে ফেঁপে ওঠা কাঠামো, নগণ্য বরাদ্দ-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেট ১,০৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে গবেষণা কেন্দ্রগুলো পেয়েছে ২১.৫৭ কোটি—মোট বাজেটের মাত্র ২.০৮ শতাংশ।
অধ্যাপক মামুন ও ইসলাম দুজনেই মনে করেন, বরাদ্দ অপ্রতুল। অনাক্রম্য কেন্দ্রগুলো বন্ধ বা একীভূত করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ক্রোমোজোম ও বায়োটেকনোলজি সেন্টার অনেকটাই একই কাজ করে, তাই একত্রিত করা সম্ভব।
অ্যাডভান্সড স্টাডিজ ইন হিউম্যানিটিজ রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক জসিম উদ্দিনও বলেন, “এতগুলো কেন্দ্রের দরকার নেই। অধিকাংশ নিষ্ক্রিয়। প্রতিটি অনুষদে একটি কেন্দ্র থাকলেই যথেষ্ট। এখন যেভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তাতে সম্পদ অপচয় হচ্ছে।”
এখনও টিকে আছে সেমিকন্ডাক্টরের স্বপ্ন-
সেমিকন্ডাক্টর গবেষণা কেন্দ্রই হারানো সুযোগের সেরা উদাহরণ। অধ্যাপক সুলতান আহমেদ অনেক আগেই বুঝেছিলেন, ভবিষ্যৎ গড়বে চিপ। আজ সোলার প্যানেল থেকে স্মার্টফোন, চিকিৎসা যন্ত্র—সবখানেই এর প্রভাব। তাইওয়ান আগে থেকেই বিনিয়োগ করে বিশ্বকেন্দ্র হয়েছে; যুক্তরাষ্ট্র আজ তা সামরিকভাবেও রক্ষা করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষকরা এখানে ন্যানোপার্টিকলের গঠন নিয়ে কাজ করেন, কিন্তু উন্নত গবেষণার জন্য প্রায়ই বিসিএসআইআর বা বুয়েটের উপর নির্ভর করতে হয়। চাহিদা এত বেশি যে এক মাস আগে স্লট বুক করতে হয়।
বর্তমান পরিচালক ড. মুজিব লেনিন পালাশ বলেন, “আমরা মূলত মৌলিক গবেষণা করি। চিপ তৈরি বহু ধাপের প্রক্রিয়া। আমাদের কাজ একাডেমিক ভিত্তি গড়ে তোলা, শিল্পখাত পরে এগিয়ে নেয়।”
তিনি জানান, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাদের গবেষণা শীর্ষস্থানীয় জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তবুও গবেষণার অনুকূল পরিবেশ না থাকায় প্রতি ৭০ স্নাতকের মধ্যে ১৫ জন দেশ ছাড়েন।
অন্যদিকে ভারতের পরিবেশ এতটাই শক্তিশালী যে বিদেশে থাকা গবেষকেরাও দেশে ফিরতে আগ্রহী হন।
অধ্যাপক মামুন যুক্তি দেন, “এটি তৈরি পোশাক শিল্পের মতো নয়, যেখানে আমরা অন্যদের উপর নির্ভর করি। সেমিকন্ডাক্টরে বরং বিশ্ব নির্ভর করে যারা উৎপাদন করতে পারে তাদের উপর।”
পালাশ আশাবাদী সুরে বলেন, “বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ক্ষুদ্র পরিসরে চিপ ডিজাইন শুরু করেছে। কিছু মার্কিন কোম্পানি এখানে কাজ আউটসোর্স করছে। তরুণ প্রকৌশলীরা যুক্ত হচ্ছেন। শিল্পায়নের পর্যায়ে যেতে হলে সুসংগঠিতভাবে জনবল তৈরি করতে হবে।”
কার্যকর গবেষণা কেন্দ্রের শর্ত-
অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি প্রয়োজন নেতৃত্ব, অবকাঠামো ও জনবল।
বিজনেস রিসার্চ ব্যুরোর পরিচালক অধ্যাপক এবিএম শহিদুল ইসলাম মনে করেন, পরিচালকদের পূর্ণকালীনভাবে কাজ করতে হবে। “তাদের অন্য দায়িত্বে ব্যস্ত রাখা যাবে না।”
তাঁদের ব্যুরো বিজ্ঞাপন সংস্থা, শিল্প নিরাপত্তা, পর্যটনের প্রভাব, ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করেছে। বর্তমানে তারা মসলিনসহ পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতির জন্য ঐতিহাসিক ও পরিবেশগত প্রমাণভিত্তিক গবেষণা করছে। পাশাপাশি তরুণ গবেষকদের উন্নত ডেটা টুলস শিখাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মহাসাগর শাসন কেন্দ্রের পরিচালক ড. কে এম আজম চৌধুরী জানান, “২০ বছর আগে সাগর নিয়ে কেউ ভাবেনি। ২০১২ সালের পর ব্লু ইকোনমি গুরুত্ব পায়। এখন আমাদের কেন্দ্রটি সক্রিয়তমগুলোর একটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ না থাকলেও আন্তর্জাতিক সহায়তা পাই।”
তাঁরা চীনের ফার্স্ট ইনস্টিটিউট অব ওশানোগ্রাফির সঙ্গে কাজ করছে, ইতালি ও ফ্রান্স থেকেও বিশেষজ্ঞ আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। গবেষণার বিষয়: সমুদ্রের অম্লতা ও প্রাথমিক দুর্যোগ সতর্কীকরণ। বার্ষিক মাত্র ৬ লাখ টাকায় শিক্ষার্থী ও তরুণ শিক্ষকদের প্রকল্পে সহায়তা করছে।
চৌধুরীর মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ব্যাপী স্পষ্ট নীতি প্রয়োজন। “তবেই গবেষণা কেন্দ্রগুলো প্রকৃত মূল্য দিতে পারবে।”
প্রফেসর মামুন শেষ পর্যন্ত বললেন, “গবেষণা শুধু দেশের নয়, সারা বিশ্বের সম্পদ। বোস-আইনস্টাইন তত্ত্ব এখনও আমাদের পদার্থ ও আলোর প্রকৃতি বুঝতে সাহায্য করে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী করবে। গবেষণার ফল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয়, নতুন দরজা খোলে। উন্নত দেশগুলো টিকে আছে কারণ তারা এটা বোঝে। আমরা পিছিয়ে আছি কারণ আমরা তা বুঝি না।”
সূত্র: টিবিএস

