প্রকৃতি অকৃপণভাবে বাংলাদেশকে উপকূল, বন, পাহাড় ও সবুজ উপত্যকায় সমৃদ্ধ করেছে। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়, সুন্দরবনের অপরূপ জঙ্গল এবং বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য—সবকিছুই রয়েছে। তবে এই সম্ভাবনাময় পর্যটন খাত বিদেশি পর্যটকের আগমনে এখন সংকটে। নীতিনির্ধারকরা আশা জাগানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও, বাস্তবে ব্যবসায়ীরা ক্রমশ গুটিয়ে নিচ্ছেন কার্যক্রম।
ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, পর্যটন প্রচারণার অভাব এবং সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি—এই তিনটি কারণে দেশের পর্যটন খাত এখন অস্তিত্ব সংকটে। বিদেশি পর্যটকের অনুপস্থিতিতে সকল আয়োজন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে এবং এ খাতের অর্থনৈতিক প্রবাহ ও বৈদেশিক মুদ্রা আয় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
পর্যটন কেন্দ্রগুলোর অবকাঠামো ঘাটতি, মানসম্মত হোটেল-মোটেল ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অভাবও বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার জন্য যে পরিকল্পিত প্রচারণা প্রয়োজন, তা নেই বললেই চলে। নিরাপত্তা ও ভ্রমণ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যও যথাযথ ব্যবস্থা নেই। এই কারণে বিদেশি পর্যটকরা নিরাপদ ও স্বস্তির অনুভূতি না পেয়ে দেশের বাইরে ভ্রমণে পছন্দ করছে।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে বিদেশি পর্যটকের বুকিং প্রায় ৬০–৭০ শতাংশ কমে গেছে। কক্সবাজার, সুন্দরবন, সিলেটের মতো আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় ইউরোপ ও আমেরিকার পর্যটকের আগমন এখন প্রায় নেই বললেই চলে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং স্থানীয় পর্যটন শিল্পের টেকসই উন্নয়নে।
আজ ২৭ সেপ্টেম্বর দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব পর্যটন দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো ‘টেকসই রূপান্তরের জন্য পর্যটন’। কিন্তু এ খাতে বিনিয়োগ ও উন্নয়নের বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করলে বিষয়টি আশঙ্কাজনক।
ছোট ও বড় ব্যবসায়িরা ভেঙে পড়ার পথে: গত এক দশকে পর্যটন খাতে বিনিয়োগ করে টিকে থাকা অনেক ব্যবসায়ী এখন পুঁজি হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন। রাজধানীর একটি শীর্ষস্থানীয় ট্যুর অপারেটরের প্রধান নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমাদের ৮০ শতাংশ ব্যবসা ছিল বিদেশি পর্যটক নির্ভর। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে একের পর এক বুকিং বাতিল হয়েছে। এখন অফিস খরচ চালানোই দায়। বাধ্য হয়ে ১০ জন কর্মীর মধ্যে ছয়জনকে ছাঁটাই করতে হয়েছে। এভাবে চললে ব্যবসা বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না।”
প্যাসিফিক এশিয়া ট্র্যাভেল অ্যাসোসিয়েশন (পাটা) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাসচিব তৌফিক রহমান জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতার খবর এবং সহিংসতার প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নেতিবাচকভাবে পরিবেশিত হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রায় ২০টি দেশের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো তাদের নাগরিকদের জন্য সতর্কতা জারি করেছে। ফলে বিদেশি পর্যটক আগমন ৭০–৮০ শতাংশ কমে গেছে।
সংকটের বহুমুখী কারণ: উদ্যোক্তা ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সংকটের পেছনে একক কোনো কারণ নেই। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যার বিস্ফোরণ ঘটছে।
প্রধান কারণগুলো হলো—
১. সমন্বয়হীনতা: পর্যটন মন্ত্রণালয়, পর্যটন করপোরেশন, ট্যুরিজম বোর্ড এবং স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। অন-অ্যারাইভাল ভিসা জটিলতা, ই-ভিসা চালু না হওয়া এবং বিমানবন্দরেই পর্যটকের হয়রানি সমস্যাগুলো ভ্রমণ আকর্ষণকে প্রভাবিত করছে।
২. অদক্ষতা ও পরিকল্পনার ঘাটতি: সংকট উত্তরণের জন্য কার্যকর নীতি ও পদক্ষেপ নেই। পর্যটন মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন ধীরগতি। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ভ্রমণ ও পর্যটন উন্নয়ন সূচকে ১১৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১০তম অবস্থানে রয়েছে।
৩. প্রচার ও ব্র্যান্ডিংয়ের অভাব: আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরার কার্যকর প্রচারণা নেই। ডিজিটাল মার্কেটিং এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কার্যকর উপস্থিতি না থাকার কারণে ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডিং কার্যকর হয়নি।
৪. প্রতিবেশী দেশের তুলনায় পিছিয়ে থাকা: ইউনাইটেড নেশনস ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেশনের (ইউএনডাব্লিউটিও) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে মালদ্বীপের পর্যটন আয় ৪.৫ বিলিয়ন ডলার, নেপালের আয় ৮০০ মিলিয়ন ডলার, কিন্তু বাংলাদেশের আয় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের নিচে। যুদ্ধবিধ্বস্ত শ্রীলঙ্কাও পুনরুজ্জীবিত হয়েছে, অথচ বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে রয়েছে।
৫. পর্যটকের সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাব: বছরে কতজন বিদেশি পর্যটক আসে, তার নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহান জানিয়েছেন, ২০২৪ সালে ছয় লাখ ২৫ হাজারের বেশি বিদেশি নাগরিক এসেছে, তবে প্রকৃত পর্যটকের সংখ্যা কম হতে পারে।
পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান সায়মা শাহীন সুলতানা জানিয়েছেন, দেশের জিডিপিতে পর্যটনের অবদান মাত্র ৩ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। ২০২৪ ট্যুরিজম নীতিমালা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে, যা ২০১০ সালের নীতিমালার উন্নত সংস্করণ।
উদ্যোক্তারা হতাশ: ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান বলেন, “পর্যটন মহাপরিকল্পনা না থাকায় অবকাঠামো অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। তবে সুযোগ শেষ হয়নি। কক্সবাজারে বিদেশিদের জন্য পরিকল্পিত আবাসন তৈরি করা সম্ভব, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিতে বিপুল বিনিয়োগ করা যেতে পারে।”
পর্যটন বিচিত্রার সম্পাদক মহিউদ্দিন হেলাল জানান, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হলে নেপাল, ভুটান, খুনমিং ও ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যের পর্যটকরা কক্সবাজারে আসবেন। কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পর্যটনপণ্য হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজন।
ট্যুর গাইড অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুল ইসলাম বলেন, “পর্যটক আনার জন্য শুধু বিমানবন্দর নয়, কক্সবাজারকেও সাজাতে হবে। রোড শো ও প্রচারণা চালাতে হবে। বিদেশি ভাষা জানানো গাইডের অভাবও সমস্যার কারণ।”
আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি কাজে লাগানোর পরামর্শ: প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা যেতে পারে।
বেসরকারি খাতই মূল চালিকাশক্তি। কক্সবাজার, সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রামে হোটেল-রিসোর্টে অনেক বিনিয়োগ হয়েছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা ঘাটতি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে।
ব্র্যান্ডিংয়ের দুর্বলতা: ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ কার্যকর হয়নি। দীর্ঘমেয়াদি বিপণন, লক্ষ্য মার্কেট নির্ধারণ, পর্যটকদের জন্য সুবিধা ও প্রচারণার সুস্পষ্ট কৌশল প্রয়োজন।
বিশ্ব পর্যটন দিবস উদযাপন: আজ ২৭ সেপ্টেম্বর, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, পর্যটন বিশ্বজুড়ে টেকসই উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি। পর্যটন শিল্পের বিকাশ স্থানীয় উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ ও পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি করছে। তরুণ প্রজন্মকে এ ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ পর্যটনের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাবনাময় দেশ। পর্যটন শিল্পের সঠিক ব্যবস্থাপনা দেশের অর্থনীতি, সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

