বাংলাদেশে হৃদরোগের চিকিৎসা এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে এ সক্ষমতা ঢাকার বাইরে খুব কমই বিস্তৃত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের রোগীদের জন্য ঢাকাই শেষ ভরসা।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৯৫ শতাংশ হৃদরোগীর অস্ত্রোপচার ঢাকায় হয়। চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগীয় শহরে সীমিত পরিসরে চিকিৎসা করা হয়। দেশে মোট ৩৪টি হাসপাতালে হৃদরোগের অস্ত্রোপচার হয়, যার ২৬টি কেন্দ্রই ঢাকায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি সারা দেশে পরিকল্পিত ব্যবস্থা থাকত, রোগীদের এই দুর্ভোগ কমত।
আজ সোমবার পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’। এবারের প্রতিপ্রাদ্য ‘প্রতিটি হৃদস্পন্দনই জীবন’। দিবসটি উপলক্ষে দেশে নানা কর্মসূচি চলছে।
গত দুই দশক ধরে হৃদরোগীর সংখ্যা বাড়লেও গবেষণা কম হয়েছে। ঠিক কত মানুষ আক্রান্ত, কতজন মারা যাচ্ছে বা ঝুঁকিতে আছে—এ বিষয়ে জাতীয় পরিসংখ্যান নেই। গবেষক ও নীতিনির্ধারকরা মূলত আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যের ওপর নির্ভর করছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, হৃদরোগ বিশ্বে মৃত্যুর প্রধান কারণ। প্রতিবছর আনুমানিক এক কোটি ৮০ লাখ মানুষ হৃদরোগ ও স্ট্রোকের কারণে মারা যায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ ৮৩ হাজার মানুষ হৃদরোগে মারা যায়, যা মোট মৃত্যুর ৩৬ শতাংশ।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের রোগীর বেশির ভাগই হার্ট অ্যাটাকের পর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। অর্থাৎ, যখন ধমনিতে চর্বি জমে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, তখন অনেকের হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে।
চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, ওষুধ বা অন্যান্য উপায়ে যখন হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় না, তখন ওপেন হার্ট সার্জারি, বাইপাস সার্জারি, হার্ট ভাল্ভ মেরামত বা প্রতিস্থাপন করতে হয়। এছাড়া জন্মগত হৃদরোগ, এওর্টার ক্ষতি বা প্রসারণ, গুরুতর হার্ট ফেইলিউর হলে হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের প্রয়োজন হতে পারে।
বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার তালিকায় বাংলাদেশ দশম স্থানে আছে। এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বিদেশে যাওয়ার ১২.২০ শতাংশ রোগী হার্ট অপারেশনের জন্য যাচ্ছে। এছাড়া চোখের চিকিৎসা ১০.৫৩ শতাংশ, কিডনি ৮ শতাংশ, ক্যান্সার ৭.৫২ শতাংশ, ফ্রাকচার ৭.৫২ শতাংশ, হাড়ের সমস্যা ৬.৯৩ শতাংশ। এছাড়া লিভার, ডায়াবেটিস ও গাইনির সমস্যার জন্যও রোগীরা বিদেশে যাচ্ছেন।
ইউনাইটেড হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. সাইদুর রহমান খান বলেন, “১৯৮০-এর দশকে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে জাপানি কার্ডিয়াক সার্জারির সাহায্যে বাংলাদেশে হার্ট সার্জারির সূচনা হয়। তখন চিকিৎসা প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। অধ্যাপক এস আর খান ও অধ্যাপক নবী আলম খান বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথম কার্ডিয়াক সার্জারি শুরু করেন। প্রথমদিকে মানুষের আস্থা কম ছিল, এখন মৃত্যুর হার ১ শতাংশের কম। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।”
তিনি আরও জানান, “সবচেয়ে বেশি রোগী ভুগছে রক্তনালির ব্লক, এরপর হার্ট ভাল্ভ ও জন্মগত হৃদরোগে। সব ধরনের অপারেশন বাংলাদেশে করা সম্ভব এবং মৃত্যুর হার প্রায় নেই বললেই চলে।”
দেশে প্রতিবছর জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে প্রায় ৭৩ হাজার শিশু জন্মগ্রহণ করে। যার মধ্যে অনেক শিশুকে দ্রুত চিকিৎসা না দিলে ঝুঁকি দেখা দেয়। অধ্যাপক এস আর খান বলেন, “একটি হার্টের ভাল্ভের দাম প্রায় এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা, যা বেশির ভাগ রোগীর জন্য উচ্চমূল্যের। তাই রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।”
তিনি আরও যোগ করেন, “সুস্থ জীবনযাপন হৃদরোগ প্রতিরোধের মূল। স্বাস্থ্যকর খাদ্য—শাক-সবজি, ফলমূল, মাছ খেতে হবে। লবণ, চিনি, তেল, প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। নিয়মিত হাঁটা ও ব্যায়াম করতে হবে, সপ্তাহে অন্তত ১২০ মিনিট। তামাক ও অ্যালকোহল সম্পূর্ণ বর্জন করতে হবে। ওজন নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মিত খেলাধুলা জরুরি।”

