রাষ্ট্রের রুদ্রমূর্তি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভবত কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে আবার রাষ্ট্রের মানবিক চেহারা রক্ষণাবেক্ষণের প্রধান হাতিয়ার পুলিশ ও প্রশাসন। তাই স্বাধীন পুলিশ ও জনপ্রশাসনের জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করার কথা। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের পেশাগত আচরণ বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষিত নয়। এতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ সম্ভব ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে জনপ্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা বরাবরই বিতর্কিত। বিশেষত বিগত সরকারের শাসনামলে জনপ্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তারা জনগণের সেবক না হয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের সহযোগী হয়ে উঠেছিল, অর্থাৎ ফ্যাসিবাদী কাঠামো টিকিয়ে রাখতে তৎপর ছিল।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী দেশে জনগণের প্রত্যাশা ছিল, জনপ্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীতে আমূল সংস্কার হবে। জনপ্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার ছাড়া সরকারের ফ্যাসিবাদ দমনের চেষ্টা সফল হবে না। যেমনটি শুরুতেই বলেছি, ফ্যাসিবাদী সরকার তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে জনপ্রশাসন ও পুলিশকেই ব্যবহার করে থাকে। এ দুই প্রতিষ্ঠান যদি সংস্কার না করা হয়, তাহলে তারা ফ্যাসিবাদী সরকারের হাতিয়ার হিসেবেই কাজ করতে থাকবে। জনগণের সেবক হওয়ার পরিবর্তে তারা ক্ষমতাসীনদের সহযোগী হয়ে জনগণের ওপর দমন-পীড়ন চালাবে।
জনপ্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার বিলম্বিত হলে জনবান্ধব, জবাবদিহিমূলক এবং নিরপেক্ষ প্রশাসন ও পুলিশ গঠন সম্ভব হবে না; বরং গণতান্ত্রিক শাসনপ্রক্রিয়া আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। এমনকি সরকারের অন্যান্য উদ্যোগও কার্যকর ফল দেবে না। তাই ফ্যাসিবাদ দমনে জনপ্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে দৃশ্যমান পদক্ষেপ প্রয়োজন।
বাংলাদেশে তাই টেকসই গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের বাস্তবায়ন করতে হলে জনপ্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার অনিবার্য। তবে এই দুই সংস্কারই অনেকটা বৃহত্তর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সংস্কারের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন শতাধিক সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিটির সংস্কার প্রস্তাবগুলোর লক্ষ্য ছিল জনপ্রশাসনকে জনমুখী, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা। যদিও এ প্রতিবেদন জমা পড়ার সাত মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো মৌলিক কোনো সুপারিশেরই বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়নি। অন্যদিকে বিগত সরকারের ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান কিংবা বিরোধী মতের মানুষকে দমন-পীড়নে বড় ভূমিকায় ছিল পুলিশ বাহিনী। গত বছরের গণ-আন্দোলনে সারা দেশেই পুলিশ সদস্যরা ও তাঁদের স্থাপনাগুলো ব্যাপক মাত্রায় জনরোষের শিকার হয়। পুলিশকে জনবান্ধব করার লক্ষ্যে পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন দীর্ঘ যাচাই-বাছাই শেষে গত ১৫ জানুয়ারি সংস্কার প্রস্তাব, সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেয়। তবে প্রায় সাত মাসেও পুলিশে দৃশ্যমান কোনো সংস্কার বাস্তবায়িত হয়নি।
প্রায় সবাই জানি, বিগত সরকারের সময়ে দেশের জনপ্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে ভোটারবিহীন নির্বাচন, বিরোধী রাজনৈতিক মত দমন এবং বিরোধী আন্দোলনে পুলিশি নিপীড়ন পুলিশের প্রতি জনগণের মধ্যে চরম অসন্তোষ ও আস্থাহীনতা তৈরি করেছে। সরকারের অনুগত আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তারা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে দলীয় স্বার্থ রক্ষা করেছেন, যা এ দুই প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এ ছাড়া প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকাণ্ডে জবাবদিহির অভাব রয়েছে। হেফাজতে নির্যাতন, বেআইনি গ্রেপ্তার, গুম ও মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার—এসবই ছিল পুলিশের ‘দায়মুক্তির সংস্কৃতির’ ফল। জনপ্রশাসনেও একইভাবে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও জনসেবায় অনাগ্রহ বিদ্যমান। সংস্কারের মাধ্যমে স্বচ্ছ ও কার্যকর জবাবদিহির কাঠামো গঠন না করা গেলে এ প্রবণতা আরও বাড়বে সন্দেহ নেই এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জন–আস্থা সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবে।
বর্তমানে সচিবালয়কেন্দ্রিক প্রশাসনের যে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন চলছে, তা অনেকের মতে জনপ্রশাসনের সংস্কারের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘সিনিয়র সচিব’ পদমর্যাদার মতো সুবিধা ধরে রেখে বিগত সরকারের সময়কার প্রশাসনিক প্রভাব আজও বহাল রয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সংস্কার উদ্যোগকে বারবার আটকে দিয়েছে। বাস্তবতা হলো কোনো সরকারই এ বলয়ের বাইরে যেতে চায় না বা পারেনি। ফলে প্রশাসনিক সংস্কার রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রয়োগের ক্ষেত্রে তা বারবার উপেক্ষিত হচ্ছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে একটি দক্ষ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন কখনো গড়ে উঠবে না।
শুধু কাঠামোগত সংস্কার নয়, পুলিশের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনা জরুরি। অনেকের ধারণা, পুলিশের শৃঙ্খলাগত ও নীতিগত বিষয় সংস্কার করা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ থেকে পুলিশকে বের করে আনা এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে পারলে কাঠামোগত পরিবর্তন আসবে। মানুষ এমন একটি কাঠামোর প্রত্যাশা করে, যেখানে জনগণ ও পুলিশের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে এবং পারস্পরিক আস্থা গড়ে উঠবে। যেহেতু গণতন্ত্রে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস, তাই পুলিশকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ করার ব্যবস্থা থাকা দরকার। এভাবেই একটি দায়িত্বশীল, মানবিক ও জনবান্ধব পুলিশি ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে যে রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের মেলবন্ধন হয়েছে, তা জনবিচ্ছিন্ন একধরনের কর্তৃত্ববাদী সংস্কৃতি তৈরি করেছে। এ সংস্কৃতির অবসান ও টেকসই গণতন্ত্রের ভিত গড়তে হলে প্রশাসন এবং পুলিশ বাহিনীতে কাঠামোগত ও নীতিগত সংস্কার অপরিহার্য। তা না হলে ভবিষ্যতেও যেকোনো রাজনৈতিক সরকার এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবে, আর জনগণ সেই তিমিরেই থেকে যাবে। বাংলাদেশে তাই টেকসই গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের বাস্তবায়ন করতে হলে জনপ্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার অনিবার্য। তবে এই দুই সংস্কারই অনেকটা বৃহত্তর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সংস্কারের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
- মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক