বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে কাজ করা নারী শ্রমিকদের জীবনযাত্রা এখনও অনেক দিকেই সংকটপূর্ণ। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি)-এর একটি গবেষণায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এই শিল্পের প্রতি তিন নারী শ্রমিকের মধ্যে দুজনই ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়েছে, এবং তাদের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশই কম বয়সে গর্ভধারণ করেছেন।
গবেষণাটি ‘পোশাকশিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার’ শীর্ষক সেমিনারে আলোচকরা তুলে ধরেন। সেমিনারে অংশ নেন পপুলেশন কাউন্সিল বাংলাদেশের সাবেক পরিচালক ড. উবাইদুর রব, বিকেএমইএর যুগ্ম সম্পাদক ফারজানা শারমিন, এবং মেরী স্টোপস বাংলাদেশের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াসমিন এইচ আহমেদ।
২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা, কড়াইল ও মিরপুর বস্তি ও গাজীপুরের টঙ্গী বস্তিতে পরিচালিত জরিপে ১৫ থেকে ২৭ বছর বয়সী ৭৭৮ নারী শ্রমিকের সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ ও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ফলাফল দেখায়, এই শ্রমিকদের মধ্যে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন জীবনে অন্তত একবার অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শিকার, আর প্রতি চারজনের মধ্যে একজন গর্ভপাতের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
পরিবার পরিকল্পনা ও সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি দেখা গেছে। জরিপ শুরুতে ৪৯ শতাংশ নারী দীর্ঘমেয়াদি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে জানতেন, যা দুই বছরের মধ্যে বেড়ে ৭০ শতাংশে পৌঁছেছে। জরুরি গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট বা বড়ি সম্পর্কে জ্ঞানও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
কিন্তু সহিংসতার চিত্র এখনও উদ্বেগজনক। নারী শ্রমিকরা ঘর ও কর্মক্ষেত্রে উভয় ক্ষেত্রেই মানসিক ও শারীরিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। শুরুতে ৪৮ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে মানসিক সহিংসতার শিকার হলেও দুই বছর পরে এটি বেড়ে ৫৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা আনুষ্ঠানিকভাবে সাহায্য চাইতে সাহস পান না।
গবেষকরা দেখিয়েছেন, যারা তুলনামূলকভাবে বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন এবং কমপক্ষে ৯ বছর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেয়েছেন, তাদের কিশোরী বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি কম। যারা সন্তান ধারণের আগে গর্ভনিরোধক ব্যবহার শুরু করেছিলেন, তাদের ঝুঁকি প্রায় ৪৭ শতাংশ কম।
প্রধান গবেষক ড. রুচিরা তাবাসসুম নভেদ বলেন, “অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও এই নারী শ্রমিকদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অনেকটা পিছিয়ে আছে। উন্নতির জন্য বিস্তারিত গবেষণা এবং সরকারের পাশাপাশি উন্নয়ন সংস্থা ও অংশীদারদের সম্মিলিত উদ্যোগ অপরিহার্য।”
ফারজানা শারমিন বলেন, “পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী শ্রমিকদের মতামতের গুরুত্ব কম। তাই সচেতনতা বৃদ্ধি, পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া জরুরি।”
ইয়াসমিন এইচ আহমেদ আরও যোগ করেন, “নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে শ্রমিকরা স্বল্পমেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার করতে পারছেন না। তাই কারখানাগুলোতে কাউন্সেলিং এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
ড. উবাইদুর রব বলেন, “নারীরা শুধু গার্মেন্টসেই কাজ করেন না, যেখানে কাজই করেন, সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এর জন্য তাদের জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য।”
গবেষণা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকদের জীবনযাত্রা এবং স্বাস্থ্য-অধিকার নিশ্চিত করা একটি জাতীয় ও মানবিক দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে সরকার, প্রতিষ্ঠান, এবং সমাজের প্রত্যেক স্তরের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সত্যিকারের পরিবর্তন সম্ভব নয়।