১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সকাল আটটা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত চলেছিল। ভোট গ্রহণের মধ্যেই বোঝা যায়, ১২টি ছাত্রসংগঠনের তৈরি ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’ বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার পথে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেই প্যানেল নিয়ে উৎসাহ ও উচ্ছ্বাস ছিল প্রকাশযোগ্য।
নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হওয়ার পর ১০ ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাক পত্রিকার প্রধান শিরোনাম হয়েছিল—‘চাকসু নির্বাচনে ছাত্র ঐক্যের বিপুল বিজয়’। অন্যদিকে দৈনিক আজাদী পত্রিকা শিরোনাম করেছিল—‘চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ঐক্যের ধস নামানো জয়’। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯৯টি পদে ৮৮টিতে জয় লাভ করে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য।
নির্বাচনের পর ছাত্রশিবির সংবাদ সম্মেলন করে কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ তোলে। তবে এসব অভিযোগ পরবর্তীতে তাত্ত্বিক বা কার্যকর প্রমাণ ছাড়া ‘হাওয়ায়’ মিলিয়ে যায়। একই দিন ছাত্র ঐক্যের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম নগরে বিজয় মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
বিজয় মিছিল ও শিক্ষার্থীদের উৎসব-
১০ ফেব্রুয়ারি বেলা দুইটার দিকে চট্টগ্রাম নগরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জড়ো হন। নগরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও শিক্ষার্থীরা অংশ নিতে আসেন। বিকেল চারটায় বিজয় মিছিল শুরু হয়।
মিছিলটি নিউমার্কেট, স্টেশন রোড, মোমিন রোড, আন্দরকিল্লা, লাল দিঘীরপাড় প্রদক্ষিণ করে সন্ধ্যায় আবার শহীদ মিনারে ফিরে আসে। নির্বাচনে জয়ী নেতারাও এই মিছিলে অংশ নেন।
চট্টগ্রামের পাশাপাশি কুমিল্লা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও আনন্দমিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা সাফল্য উদযাপন করেন। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৬টি বাসে শিক্ষার্থীরা জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসভবন ঘেরাও করেন। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠিত হয় মূলত শিক্ষার্থীদের চাপে। সর্বদলীয় সভার সিদ্ধান্তে ঐক্য ঘোষণা হয় এবং শিক্ষার্থীরা এই উদ্যোগে সমর্থন জানান।
সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন ও প্রেক্ষাপট-
চাকসুর পঞ্চম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮১ সালে। সেই নির্বাচনে ভিপি ও জিএস পদে নির্বাচিত হন ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন নেতা জসিম উদ্দিন সরকার ও আবদুল গাফফার। ষষ্ঠ নির্বাচনে ছাত্রশিবির জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিল। তবে তাদের বিপরীতে ১২টি ছাত্রসংগঠন মিলিত হয়ে গঠন করেছিল সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য।
এই ১২টি সংগঠনের মধ্যে ছিল—ছাত্রলীগ (হাবিবুর রহমান ও অসীম কুমার), জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ (আবদুস সাত্তার ও মোশারফ হোসেন), ছাত্রলীগ (নাজমুল হক ও শফি আহমেদ), ছাত্রলীগ (বজলুল রশীদ ও আজম), জাতীয় ছাত্রলীগ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র মৈত্রী, ঐক্য সমিতি, ছাত্র ফেডারেশন ও গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়ন। নাজমুল হক ও শফি আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগ জাসদের সমর্থক ছিল।
‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’ সহজে তৈরি হয়নি। নির্বাচনের আগে জানুয়ারি মাসে একদিন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসভবনে সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, বিএনপির নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, সিপিবি শাহ আলম, বাসদ নেতা বালাগাত উল্লাহ, জাসদ নেতা আবুল কালাম আজাদসহ অন্যান্য নেতা-কর্মী।
সর্বদলীয় সভার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৬টি বাসে শিক্ষার্থীরা বাসভবন ঘেরাও করেন। ফলে শিক্ষার্থীদের চাপের কারণে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ঘোষণা হয়। সাবেক জিএস আজিম উদ্দিন আহমদ উল্লেখ করেন, ঐক্য গঠনের সিদ্ধান্তের পর শিক্ষার্থীদের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়।
ভোট ও বিজয়-
চাকসুর সর্বশেষ নির্বাচনে মোট ভোটার ছিলেন ১০ হাজার ৫২৬, যার মধ্যে ছাত্রীরা ২ হাজার ২৭৬। চাকসুর ২৭টি পদে প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ১৫৮। ছয়টি হলে ৭২টি পদে প্রার্থী ছিলেন ৪৩৬ জন।
সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্যানেল থেকে ভিপি পদে ছিলেন জাতীয় ছাত্রলীগের মো. নাজিম উদ্দিন, আর জিএস পদে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাবেক সভাপতি আজিম উদ্দিন আহমদ। দুজনেই বিপুল ভোটে জয়ী হন।
ভিপি পদে নাজিম উদ্দিন পেয়েছিলেন ৪ হাজার ৮৩১ ভোট; তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রশিবিরের হামিদ হোসেন পেয়েছিলেন ২ হাজার ৭৭৪ ভোট। জিএস আজিম উদ্দিন আহমদ ৪ হাজার ৯৬৩ ভোট পেয়ে জয়ী হন; তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রশিবিরের মানছুর আহমদ পেয়েছিলেন ২ হাজার ৬২৫ ভোট। এজিএস পদে নির্বাচিত হন তৎকালীন ছাত্রদলের মাহবুবের রহমান, ৪ হাজার ৯৯১ ভোটের মাধ্যমে।
চাকসুর নির্বাচনে ভোট প্রচারণা চলাকালে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সাড়া পেয়েছিলেন প্রার্থীরা। মাহবুবের রহমান উল্লেখ করেন, শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রচারণা কার্যকর এবং তাদের প্রতিশ্রুতির প্রতি সমর্থন ছিল নির্বাচনে ভালো ফলাফলের মূল কারণ।
পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও নতুন নির্বাচন-
আগামী ১৫ অক্টোবর সপ্তম চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এবারের নির্বাচন বিশেষ পরিস্থিতিতে হচ্ছে। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ফলে ছাত্রলীগের প্রভাব কমে যায়। এবারের নির্বাচনে ছাত্রদল, বামপন্থী সংগঠন, ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন অংশ নিচ্ছে। ইতিমধ্যে ১৩টি প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে।
ছাত্র ঐক্যের মতো একক প্যানেল গঠনের চেষ্টা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। মূলত পদের সমঝোতা ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে কোনও সর্বদলীয় প্যানেল গঠন করা যায়নি। এবারের নির্বাচনে প্রধান পদে প্রার্থীরা হলেন—ছাত্রদলের প্যানেল থেকে ভিপি পদে সাজ্জাদ হোসেন, জিএস পদে মো. শাফায়াত হোসেন। ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেল থেকে ভিপি পদে ইব্রাহিম হোসেন, জিএস পদে সাঈদ বিন হাবিব।
বামপন্থী ‘দ্রোহ পর্ষদ’ প্যানেল থেকে ভিপি পদে ঋজু লক্ষ্মী অবরোধ, জিএস পদে ইফাজ উদ্দিন। ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ প্যানেল থেকে ভিপি পদে ধ্রুব বড়ুয়া এবং জিএস পদে সুদর্শন চাকমা মনোনয়ন পেয়েছেন।
চাকসুর ইতিহাসে ১৯৯০ সালের এই নির্বাচনের ফলাফল ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য এক অধ্যায়ের সমাপ্তি হলেও সেই দিন শিক্ষার্থীদের ঐক্য, উদ্যোগ এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা দেশের ছাত্ররাজনীতিতে দীর্ঘকাল প্রভাব রেখেছে।