কবি-চিন্তক ফরহাদ মজহার অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছেন, রাষ্ট্র কেবল গ্রামীণ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান চলানোই নয়—রাষ্ট্রের অর্থ নয় এমন সীমাবদ্ধ বোঝাপড়া তাকে মেনে নেওয়া যায় না।
আজ (মঙ্গলবার) জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত ‘ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা ও নির্বাচন’ শীর্ষক আলোচনা সম্মেলনে—যেটি সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড পিস স্টাডিজ আয়োজিত—ফরহাদ মজহার উপরের কথাগুলো বলেন এবং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গণঅভ্যুত্থান ও অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে তাঁর ক্ষোভপ্রকাশ করেন।
নির্বাচন প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য ছিল কঠোর ও প্রশ্নবোধক: ‘যদি এই রাষ্ট্র থেকেই মুক্ত হওয়া না যায়, তাহলে নির্বাচন নিয়ে কথা বলা অর্থহীন। ড. ইউনূস—আপনি কেন নির্বাচন করবেন? আপনার অবস্থানটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়।’
মজহার বলেন, জনগণের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হওয়া পরিবর্তনকে তিনি সম্মান করেন; কিন্তু সেই আন্দোলনের নেতা বা প্রবক্তা হিসেবে নিজেকে দাবি করার অধিকার কারো একক নয়—এটি জনগণের অংশগ্রহণ ও সংগ্রামের ফল।
তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক কোনো এক ব্যক্তি নয়; এটি জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।’
ফরহাদ মজহার আরো বলেন, গণঅভ্যুত্থানের সময় বহু তরুণ ও সাধারণ মানুষ লাফিয়ে এগিয়ে এসে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছে—জানিয়ে দিয়েছেন বলেই আজকের পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, অনেকে গণঅভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে নিজেদের ভূমিকা বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করছেন, আবার কেউ কেউ এই আন্দোলনের স্বার্থ ও লক্ষ্য বোঝেননি।
বিশেষত তিনি বলেন, ‘‘আমরা আশা করেছিলাম ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক মঞ্চে আমাদের দুর্বল রাষ্ট্রীয় অবস্থার দুর্বলতাগুলো মোকাবিলায় কাজ করতে সক্ষম হবেন; কিন্তু যে পথে তিনি যাচ্ছে, তা দেশের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।’’
প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়ে কড়া সমালোচনা করে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘‘প্রথমত তিনি ভুল করেছেন—তিনি এসে কিছু তরুণকে ধরে এনে ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে উপস্থাপন করলেন। এটা কীভাবে ঘটল তা আমার বোধগম্য হয়নি। গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব কোনও এক ব্যক্তির একচেটিয়া অধিকার নয়; এখানে নানা ধরণের অংশগ্রহণকারী ছিল—শিবিরের মানুষ, সেকুলার চিন্তাবিদ, বামপন্থী, ছাত্র-নেতারা—সবাই মিলে এই আন্দোলনকে এগিয়ে এনেছে।’’
তিনি জোর দিয়ে বলেন, আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ফ্যাসিস্ট শাসন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভাঙা এবং নতুন রাষ্ট্র গঠনের পথ শুরু করা—এই লক্ষ্যকেই তারা বুকে ধারণ করে শহীদদের আত্মা উৎসর্গ করেছেন।
ড. ইউনূসের নির্বাচনী পরিকল্পনা-উদ্যোগ নিয়ে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, ‘‘প্রধান উপদেষ্টা কোন মাপকাঠি দেখে নির্বাচনের কথা বললেন? রাজনৈতিক দলকে কী সংজ্ঞা দেবেন? আমাদের দেশে একেবারে সুশৃঙ্খল, জনসেবামূলক প্রকৃত রাজনৈতিক দল আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলগুলো লুটেরা-মাফিয়া শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে—যাদের কর্মকাণ্ড লুটপাট, দুর্নীতি, শোষণ। আপনি যদি তাদেরকেই ‘রাজনৈতিক দল’ বলেন, তাহলে সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ।’’
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘‘আপনি জনগণের সঙ্গে সরাসরি গিয়ে কথা বলেননি; কোনো জেলায় গিয়ে সাধারণ মানুষকে উদ্দেশ্য করে কথা বলেননি; তাদের স্বার্থ বজায় রেখে কোনো বক্তব্য দেননি।’’ তিনি এটাও যোগ করেন যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং বিদ্যমান সংবিধান অক্ষুন্ন রেখে উপদেষ্টা সরকার গঠনের সিদ্ধান্তও প্রশ্নাতীত নয়—তার বিরোধিতা মূলত এই ধারণায় যে, একটি অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা ও স্বীকৃতি কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে তা স্পষ্ট নয়।
অবৈধতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমি যদি বলি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবৈধ, তা এই মানে নয় যে আমরা তাকে প্রত্যাখ্যান করছি। বরং বলতে চাই, যিনি দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁর প্রথম কাজ হওয়া উচিত নিজের বৈধতা নিশ্চিত করা। কোথায় সংবিধানেই উপদেষ্টা সরকারের কথা পাওয়া যাবে? আপনার বৈধতার একমাত্র পথ হলো—গণঅভ্যুত্থান; এবং গণঅভ্যুত্থান সাধারণত সংবিধান মেনে হওয়া ঘটনা নয়।’’
তিনি সরকারের বৈধতা ও নৈতিক ভিত্তি নিয়ে জনমানসে সন্দেহের ইঙ্গিত দেন এবং বলেন, তাদের জন্য সময় রয়েছে রাজনীতির প্রকৃত অর্থ বুঝতে ও জনমতের সঙ্গে সংযুক্ত হতে।
প্রধান উপদেষ্টার পন্থা ও নির্বাচনী পরিকল্পনার সমালোচনায় ফরহাদ মজহার আরো বলেন, ‘‘আমি বলছি—রাষ্ট্র মানে শুধু গ্রামীণ ব্যাংক চলানো নয়। রাষ্ট্রের অর্থ হলো জনগণের কল্যাণ, ন্যায়বিচার, রাজনৈতিক উদ্যোগ, সম্মিলিত সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ; যেটা কেবল আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সঙ্গে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না।’’
সম্মেলনে উপস্থিত থাকায় ফরহাদ মজহার বললেন, গণঅভ্যুত্থানের প্রয়াসে প্রাণ হারানো ও আহত হওয়া অন্তহীন নয়—হাজারো তরুণের জীবন উৎসর্গ হয়েছে। তিনি তাঁদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে বলেন, ‘‘এই কথাগুলো আমরা ভুলতে পারি না; আমাদের আজকের কাজ হলো তাদের স্বপ্ন-আকাঙ্খা অনুযায়ী একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন করা।’’
তিনি উপস্থিত নাগরিক-সমাবেশকে অনুরোধ করেন আন্দোলনের আদর্শ অক্ষুন্ন রাখার এবং যে কোনো একক ব্যক্তিসত্বার অপব্যবহার রোখার জন্য সতর্ক থাকার।
চূড়ান্তভাবে ফরহাদ মজহার উপসংহার টেনে বলেন, ‘‘আমরা চাই রাষ্ট্রগুলো যেন মানুষের কল্যাণে নিরীক্ষণশীল হয়; রাষ্ট্র কোনো এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার খাতিরে গঠিত নয়। রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিকভাবে গঠন করা হবে—এটাই আমাদের চাওয়া।’’
তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি পুনরায় আবেদন জানান যে, মানুষের প্রত্যাশা ও গণঅভ্যুত্থানের আদর্শকে বুঝে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে।