ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট বা ডেমু ট্রেন প্রকল্পের ব্যর্থ অভিজ্ঞতা এখনো অনেকের স্মৃতিতে তাজা। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে অকেজো হয়ে পড়া ডেমু ট্রেনগুলোর কারণে কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
তবুও এবার আবারো চীনের দিকেই ঝুঁকছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। নতুন উদ্যোগে তারা ২০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক ইঞ্জিন চীনের অনুদানে আনার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। যদিও চীন এখনো লিখিতভাবে জানায়নি—এই অনুদান সরাসরি অর্থ সহায়তা হিসেবে দেবে নাকি প্রস্তুত ইঞ্জিন সরবরাহ করবে।
পুরোনো ইঞ্জিনে রেলওয়ের টানাপোড়েন-
বাংলাদেশ রেলওয়ের মোট ৩০৬টি ইঞ্জিনের মধ্যে ১৭৪টি মিটারগেজ। এর মধ্যে ১২৪টির বয়স ২০ বছরের বেশি, আর ৬৮টির বয়স ৪০ বছর ছাড়িয়েছে। অনেক ইঞ্জিনই এখন অচল বা মেরামতের অযোগ্য। পুরোনো ইঞ্জিনের রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন হয়ে পড়েছে, কারণ খুচরা যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় না এবং যেগুলো পাওয়া যায়, সেগুলোর দামও অনেক বেশি। ফলে পরিচালন ব্যয় বাড়ছে, লাভজনকতা কমছে।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, পুরোনো ইঞ্জিনগুলো প্রতিস্থাপন এখন আর বিলম্বের অবকাশ রাখে না। মিটারগেজ লাইনগুলো ডুয়েলগেজে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ায় অন্তত আরো ৩০ বছর— অর্থাৎ ২০৫৫ থেকে ২০৬০ সাল পর্যন্ত—মিটারগেজ ট্রেন চালু রাখতে হবে। তাই নতুন ইঞ্জিন সংগ্রহ অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
ব্যর্থ ডেমু প্রকল্পের স্মৃতি-
২০১৩ সালে চীন থেকে ২০ সেট ডেমু ট্রেন আমদানি করেছিল রেলওয়ে। উদ্দেশ্য ছিল শহরতলির যাত্রীচাপ মোকাবিলা ও আন্তঃনগর রেলসেবায় নতুন মাত্রা যোগ করা। কিন্তু ছয় বছরের মধ্যেই সব ট্রেন অকেজো হয়ে পড়ে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, যন্ত্রাংশ না পাওয়া এবং নকশাগত ত্রুটির কারণে এগুলো আর চলেনি। সেই প্রকল্পে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা অপচয় হয়েছিল। এখন আবারো চীনের ইঞ্জিনে বিনিয়োগের সিদ্ধান্তে অনেকের মনে শঙ্কা ফিরে এসেছে।
নতুন প্রকল্পের গঠন ও অর্থায়ন-
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনুমোদনে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) এই অনুদানের আবেদন পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১,৭২৩ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেবে ৪৯৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, আর চীনের অনুদান হবে ১,২২৫ কোটি ৬ লাখ ১০ হাজার টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫ সালের জুলাই থেকে ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত।
তবে এখনও স্পষ্ট নয়—চীন এই অর্থ সরাসরি অনুদান হিসেবে দেবে নাকি নিজ দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ইঞ্জিন সরবরাহ করাবে। এর ওপরই প্রকল্পের গতি অনেকটা নির্ভর করছে।
চীনা ইঞ্জিনের সামঞ্জস্য নিয়ে প্রশ্ন-
গবেষণা ও প্রকৌশল বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের নিজস্ব রেলওয়ে ব্যবস্থা স্ট্যান্ডার্ড গেজ (১.৪৩৫ মিটার) লাইনে চলে, যা আমাদের মিটারগেজ লাইনের (১ মিটার) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। চীনে কেবলমাত্র কিছু শিল্পাঞ্চলে সীমিত পরিসরে মিটারগেজ ব্যবহৃত হয়। তাই সেখানকার উৎপাদিত ইঞ্জিনগুলো বাংলাদেশের রেলপথ ও জলবায়ুর সঙ্গে কতটা মানিয়ে নিতে পারবে, তা নিয়ে রয়েছে প্রযুক্তিগত অনিশ্চয়তা।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, “অনুদানে আসুক বা কেনা হোক, ইঞ্জিনগুলো আমাদের পরিবেশ ও রেলপথের সঙ্গে কতটা খাপ খায় তা যাচাই করা জরুরি। ইঞ্জিনের নকশা, ক্যাবে চালকের আরামদায়ক অবস্থান, পর্যাপ্ত জায়গা—সবকিছুই প্রযুক্তিগতভাবে মূল্যায়ন করা উচিত। এজন্য ছোটখাটো হলেও একটি সম্ভাব্যতা যাচাই (ফিজিবিলিটি স্টাডি) প্রয়োজন।”
তিনি আরো বলেন, “অনুদানের হলেও ভ্যাট ও ট্যাক্স দিতে হবে আমাদেরই। রক্ষণাবেক্ষণের বোঝা যদি শেষ পর্যন্ত আমাদের ওপরই পড়ে, তাহলে সেটি কার্যকর হবে না।”
লোকোমাস্টারদের অভিজ্ঞতা ও আশঙ্কা-
বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান বলেন, “একটা ইঞ্জিন এনে যদি ২০ বছরও চালানো না যায়, তাহলে সেটা লোকসান। শুধু ইঞ্জিন আনলেই হবে না, স্পেয়ার পার্টসও নিশ্চিত থাকতে হবে। রাস্তায় ইঞ্জিন বিকল হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু যন্ত্রাংশ না থাকলে সেটি দীর্ঘদিন বসে থাকবে।”
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ২০২০ সালে আনা ৩০টি মিটারগেজ ইঞ্জিনের অনেকগুলোই এখন অচল। “৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনগুলোর পার্টস পাওয়া যায় না। জোড়াতালি দিয়ে কোনোমতে চলছে, অর্ধেক বসে গেছে। এখন নতুন ইঞ্জিন আনলে যেন এই সমস্যা না হয়,” বলেন তিনি।
রেল মন্ত্রণালয়ের বৈঠক ও নির্দেশনা-
রেলপথ সচিব মো. ফাহিমুল ইসলামের সভাপতিত্বে সম্প্রতি এক বৈঠকে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাথমিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে বলা হয়—প্রকল্পের শিরোনাম নির্ধারণের আগে নিশ্চিত করতে হবে চীন ইঞ্জিন সরবরাহ করবে নাকি শুধু অর্থায়ন করবে। বাস্তবায়নকালও যৌক্তিকভাবে নির্ধারণের পরামর্শ দেওয়া হয়।
প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (পিডিপিপি) ৬নং অনুচ্ছেদে রেলওয়ে মাস্টার প্ল্যান, এসডিজি এবং সরকারি পরিবহন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে বলা হয়েছে। ৭নং অনুচ্ছেদে ইঞ্জিন সংগ্রহের তথ্য, ১১নং অনুচ্ছেদে মে ২০২৩-এ আইআইএফসি কর্তৃক সম্পন্ন সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ফলাফল এবং ১২নং অনুচ্ছেদে নতুন ইঞ্জিন সংগ্রহের পর মোট ইঞ্জিনের সংখ্যা, খুচরা যন্ত্রাংশের পরিধি বৃদ্ধি ও ১০ বছরের রক্ষণাবেক্ষণ পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে।
এছাড়া অফিস সরঞ্জাম, বেতন ও যানবাহন ক্রয়ের ব্যয় প্রকল্প থেকে বাদ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
সচিবের বক্তব্য-
রেলপথ সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম বলেন, “প্রকল্পের প্রাথমিক অনুমোদন প্ল্যানিং কমিশনে গেছে। এখন ইআরডি চীনা দূতাবাসের মাধ্যমে প্রস্তাবটি চীন সরকারকে পাঠাবে।”
ডেমুর ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটা ডেমু নয়, ইঞ্জিন। চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত রেলব্যবস্থা পরিচালনা করছে। আমরা চীন, কোরিয়া, রাশিয়া—যেখান থেকেই পাই না কেন, মিটারগেজ ইঞ্জিনের ঘাটতি পূরণ করতেই হবে।”
লোকোমাস্টারদের প্রস্তাব ও নকশা সুপারিশ-
১২ আগস্ট বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন মহাপরিচালকের কাছে লিখিত মতামত জমা দেয়। সেখানে নতুন ইঞ্জিন কেনার ক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব দেওয়া হয়—
- ডিজাইন: নতুন ইঞ্জিনের নকশা ২৯০০ বা ৬৬০০ সিরিজের মতো হতে হবে। দৈর্ঘ্য ২৯০০ সিরিজের সমান হলে লং হুড সমস্যা কমবে। প্রয়োজনে ডাবল ক্যাব সংযোজন করা যেতে পারে।
- ক্যাব সুবিধা: উন্নত এয়ারকন্ডিশন, কার্যকর ফ্যান, পর্যাপ্ত উচ্চতা ও ইনস্পেক্টর সিট থাকতে হবে। লোকোমাস্টার ও সহকারী যেন সহজে সিগন্যাল বিনিময় করতে পারেন।
- স্বাস্থ্যসুবিধা: দীর্ঘ দূরত্বে ক্রুদের ব্যবহারের জন্য মানসম্মত শৌচাগার অপরিহার্য।
- নিরাপত্তা: ক্যাব ফ্রেম শক্তিশালী হতে হবে এবং দুর্ঘটনায় প্রেশার পাইপ যেন অকার্যকর না হয়।
প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের গুরুত্ব-
প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ইঞ্জিন পেতে হলে কিছু বিষয় অপরিহার্য বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা—
- ট্রাকশন সিস্টেমে ছয়টির বেশি মোটর থাকতে হবে, যাতে ১–২টি অকার্যকর হলেও পর্যাপ্ত গতি বজায় থাকে।
- ব্রেক সিস্টেমে এয়ার ও ভ্যাকুয়াম ব্রেকের পাশাপাশি ডাইনামিক ব্রেক যুক্ত করতে হবে।
- ক্যাবে ঘূর্ণনযোগ্য সিট, উন্নত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, মোবাইল চার্জিং পোর্ট ও রেডিও সংযোগ থাকা জরুরি।
- রাত বা কুয়াশায় দৃশ্যমানতা বাড়াতে লুক আউট গ্লাস, এলইডি প্রজেক্টর লাইট ও শক্তিশালী উইন্ডো উইপার থাকতে হবে।
- ইঞ্জিনে সামনের ও পেছনের ক্যামেরা সংযোগ, জ্বালানি ও পানি লেভেল ম্যানুয়াল মনিটরিং এবং চালক ও রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা দরকার।
রেলওয়ে কর্মকর্তারা মনে করেন, প্রশিক্ষণ ছাড়া আধুনিক ইঞ্জিন চালানো সম্ভব নয়। আগের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে চালক ও মেকানিকদের অপ্রস্তুতি অনেক দুর্ঘটনার কারণ হয়েছে।
ভবিষ্যতের দিকে নজর-
বাংলাদেশে রেল পরিবহনের ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভর করছে প্রযুক্তি-সামঞ্জস্যপূর্ণ ইঞ্জিনের ওপর। পুরোনো মিটারগেজ ইঞ্জিনগুলো প্রতিস্থাপন না করলে রেল চলাচল ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। তবে পূর্ববর্তী ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে নতুন প্রকল্পে ফিজিবিলিটি স্টাডি, রক্ষণাবেক্ষণ পরিকল্পনা ও খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে—এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের।
চীনা অনুদানে ইঞ্জিন আনতে সরকারের আগ্রহ যেমন স্পষ্ট, তেমনি রয়েছে প্রযুক্তিগত সামঞ্জস্য নিয়ে সন্দেহ। এখন দেখার বিষয়, রেলওয়ে কি এবার সত্যিই টেকসই সমাধানে পৌঁছাতে পারে, নাকি আবারো “ডেমু ট্রেনের ব্যর্থতা” ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটায়।

