বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার চীনের তৈরি ২০টি জে-১০ সিই মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। এই ক্রয়ের জন্য আনুমানিক দুই দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এত বড় একটি চুক্তি দেশের প্রতিরক্ষা খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা শুরু হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ফেসবুক প্রোফাইলে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, যুদ্ধবিমানগুলো চলতি ২০২৫-২৬ এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরে সরাসরি বা জিটুজি (G2G) পদ্ধতির মাধ্যমে চীনের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে কেনা হবে। তবে স্ট্যাটাসে বিস্তারিত ক্রয় প্রক্রিয়া, যেমন সরাসরি কিনা বা চুক্তির শর্তাবলী কী হবে, তা স্পষ্ট করা হয়নি।
এই ক্রয়বিষয়ক সিদ্ধান্তকে নির্বাচন-আগামীকালীন অবস্থায় নেওয়া নিয়ে সামরিক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের মাত্র পাঁচ মাস আগে এমন বড় ধরনের প্রতিরক্ষা ক্রয় যৌক্তিক কিনা তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এই উদ্যোগ পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপর একটি আর্থিক ও রাজনৈতিক বোঝা ফেলে দিতে পারে।
কেন যুদ্ধবিমান কেনা জরুরি?
স্থানীয় সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেছেন, বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন এবং জাতীয় আকাশ প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করতেই এই যুদ্ধবিমান কেনা হচ্ছে। সামরিক খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমানে থাকা যুদ্ধবিমানগুলোর অধিকাংশই পুরনো মডেলের। তাই দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বজায় রাখতে নতুন ও আধুনিক বিমান কেনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আ.ন.ম মুনীরুজ্জামান বলেন, “যেকোনো দেশকে হুমকির মোকাবিলায় প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বজায় রাখতে হয়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার, যাদের মেয়াদ সীমিত, তাদের এ ধরনের বড় ধরনের ক্রয় সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। এই সিদ্ধান্ত পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপর বোঝা হিসেবে পড়ে যাবে।”
তিনি আরও বলেন, যুদ্ধবিমান কেনার জন্য প্রায় দুই দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার খরচ হবে, যা দেশের প্রতিরক্ষা বাজেটের একটি বিশাল অংশ। সেজন্য এ ধরনের ক্রয় সাধারণত নির্বাচিত সরকারের হাতে রাখা হয়।

যুদ্ধবিমান কেনার ইতিহাস-
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকারের সময়ও যুদ্ধবিমান কেনার ব্যাপারে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল। ২০১৬ সাল থেকে ফ্রান্সের তৈরি রাফাল, ইউরোপীয় ইউরোপিয়ান ফাইটার টাইফুন এবং যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৬-এর মধ্যে কোন বিমান কেনা হবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। ২০২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো ঢাকায় সফরের সময় রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার প্রস্তাব দেন। তবে করোনার কারণে আর্থিক সংকট এবং বিশ্বমন্দার কারণে আলোচনা স্থগিত হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আবার এই আলোচনা সামনে আসে। যুদ্ধবিমান কেনার প্রক্রিয়া, সরাসরি কিনা বা জিটুজি পদ্ধতিতে, তা চীনের সঙ্গে চুক্তি মাধ্যমে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতের জন্য এক বড় পদক্ষেপ।
জে-১০ সিই যুদ্ধবিমানের বৈশিষ্ট্য-
জে-১০ সিই মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান মূলত দুই ধরনের কাজে ব্যবহৃত হয়: প্রতিরক্ষামূলক (ডিফেনসিভ) এবং আক্রমণাত্মক (অফেনসিভ)। ডিফেনসিভ ব্যবহার শত্রু বিমান বা হামলার প্রতিরোধে হয়, আর অফেনসিভ ব্যবহার শত্রুর ওপর আক্রমণে করা হয়। জে-১০সিই উভয় ভূমিকা পালনে সক্ষম।
বাংলাদেশের অধিকাংশ বিমান আগে ডিফেনসিভ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত, যা দেশের পররাষ্ট্রনীতি এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। জে-১০ সিই একটি সিঙ্গেল ইঞ্জিন ফাইটার, যা ম্যানুভারিং বা ‘টপ ফাইট’ ক্ষমতায় বিশেষ দক্ষ। দ্রুতগতিতে টার্ন নেওয়ার ক্ষমতা, উচ্চে ওঠার ক্ষমতা এবং ক্ষেপণাস্ত্র এড়ানোর দক্ষতা এটিকে অত্যন্ত কার্যকর করে তোলে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই যুদ্ধবিমান কম জায়গা থেকে ‘টেক অফ’ করতে পারে, ফলে শত্রুপক্ষের হঠাৎ হামলা হলেও বিমান দ্রুত নিরাপদ স্থানে উঠে যেতে পারে। এটি অ্যারোডায়নামিক্স এবং উচ্চ গতির কারণে আকাশ থেকে আকাশে এবং ভূমি থেকে আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র উভয়ের থেকে সহজে ফাঁকি দিতে পারে।
জে-১০ সিই-র সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় দুই হাজার ৪১৫ কিলোমিটার, যা উচ্চ গতিতে আক্রমণ এবং প্রতিরোধের জন্য উপযোগী। এটি রাফালের সমান প্রজন্মের যুদ্ধবিমান (৪.৫ প্রজন্ম), তবে রাডারের ক্ষেত্রে জে-১০ সিইকে শক্তিশালী বলে মনে করা হয়।

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক-
গত বছর আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম বিদেশ সফরে মার্চে চীন সফর করেন অধ্যাপক ইউনূস। এছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারাও চীন সফর করেছেন।
পরবর্তী নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে, যা এই সরকারের হাতে প্রায় চার মাস সময় রেখে যাচ্ছে। নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে প্রতিরক্ষা খাতে এত বড় চুক্তি করা কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিরাপত্তার জন্য বিমান কেনা প্রয়োজন, তবে এই সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সরকারের হাতে থাকা উচিত।
নিরাপত্তা ও কৌশলগত গুরুত্ব-
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, জে-১০সিই যুদ্ধবিমানের ম্যানুভারিং ক্ষমতা, দ্রুত ‘টেক অফ’ এবং আক্রমণ-বিরোধী ক্ষমতা এটিকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। বাংলাদেশের বর্তমান বিমানবাহিনী যেসব বিমান ব্যবহার করছে, সেগুলো বেশ পুরনো মডেলের। তাই দেশের আকাশ প্রতিরক্ষা এবং সামরিক সক্ষমতা বজায় রাখতে নতুন বিমান ক্রয় অপরিহার্য।
পরিশেষে, অন্তর্বর্তী সরকারের ২০টি জে-১০সিই যুদ্ধবিমান ক্রয়ের উদ্যোগ, যদিও নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, তা নির্বাচন-আগামী অবস্থায় নেওয়া নীতি ও আর্থিক কারণে বিতর্কিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ধরনের বড় ক্রয় পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব থাকা উচিত। তবুও দেশের আকাশ প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা এবং বিদ্যমান বিমানবাহিনীর পুরনো মডেলের কারণে নতুন যুদ্ধবিমান ক্রয় সমঝোতা একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।