বাংলাদেশে এখনও হাজারো কন্যাশিশুর দিন শুরু হয় ভয়, বৈষম্য ও নিরাপত্তহীতার মধ্য দিয়ে। বৈষম্য ও বাল্যবিয়েতে আজও থমকে থাকে তাদের ভবিষ্যৎ। তবে এই নিয়ে সরকারি-বেসরকারি কোনো কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ে না। এই অবস্থায় বিশ্বের প্রতিটি মেয়ের কণ্ঠ, সাহস ও নেতৃত্বকে তুলে ধরতে এবং বৈষম্য দূর করার অঙ্গীকার নিয়ে আজ শনিবার (১১ অক্টোবর) পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস।
জাতিসংঘের এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য– ‘আমি মেয়ে, পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিই: সংকটের মুখেও মেয়েরা’। প্রতিপাদ্যটি কন্যাশিশু নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর উদ্যোগে গঠিত হয়েছে। রংপুরের কুড়িগ্রামের জরিনা (ছদ্মনাম) এখনও মাধ্যমিকে ওঠেনি। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে তাকে।
তার বাবা বলেন, ‘মেয়ে মানুষ তো, বেশি লেখাপড়া করে কী লাভ!’ জরিনা একসময় ডাক্তার হতে চেয়েছিল। এখন সে গৃহস্থালির চার দেয়ালে বন্দি। জরিনার মতো হাজারো মেয়ে আজ নিজের ভবিষ্যৎ হারাচ্ছে বাল্যবিয়ের ফাঁদে।
‘মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯’-এ বলা হয়, বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার ১৫ বছরের নিচে ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ১৮ বছরের নিচে ৫১ দশমিক ৪০ শতাংশ। গ্রামীণ ও দরিদ্র পরিবারে এই হার আরও বেড়েছে।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের উচ্চ হার উল্লেখ করা হয়েছে। শিক্ষার ঘাটতি, কুসংস্কার, যৌতুকের ভয় এবং মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা, সংকটের নেপথ্যে এই চারটি কারণ। এ ছাড়া কৈশোরে পুষ্টির অভাবে শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়।
দেশে বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে অনলাইনে হয়রানি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক জরিপে দেখা গেছে, ৩৬ শতাংশের বেশি মেয়েশিশু অনলাইনে পুরুষবন্ধু দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়।
ব্র্যাক জাস্টিস অ্যান্ড রাইটস সেন্টারের ২০২৫ সালের জরিপ অনুযায়ী, ১০-১৮ বছর বয়সী প্রতি ৪জন মেয়ের একজন অনলাইনে হয়রানির শিকার। সরকার ২০২২ সালে ‘জাতীয় কন্যাশিশু নীতি’ গ্রহণ করলেও আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ না হওয়ায় অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।
শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে কন্যাশিশুরা: ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মাত্র ৬৪ শতাংশ শিশু মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম সমাপ্ত করে। দেশের সবচেয়ে দরিদ্র শিশু, প্রতিবন্ধী এবং দুর্যোগকবলিত অঞ্চলে বসবাসকারী প্রান্তিক শিশুরা বিদ্যালয়ের শিক্ষা না পাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মাধ্যমিকের শেষ শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না প্রায় ৪৩ শতাংশ মেয়ে।
যৌন হয়রানি: বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এর ৭০ শতাংশই কন্যাশিশু। কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বহু গুণ বেশি। কারণ লজ্জা, ভয় ও সামাজিক অপবাদে অধিকাংশ পরিবার অভিযোগ করে না।
সাভারের ১১ বছরের নীলা (ছদ্মনাম) তার স্কুলের সহপাঠীর ভাইয়ের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়। মা মামলা করতে চাইলেও গ্রামের প্রভাবশালীরা বলেন, ‘বাড়ির মানসম্মান যাবে।’
তবু মেয়েরাই বদলে দিচ্ছে বাস্তবতা: কুষ্টিয়ার তন্বী (১৫) বাল্যবিয়ের প্রস্তাবের মুখে নিজেই ‘না’ বলেছিল। এখন সে স্কুলের নেতৃত্বে কাজ করে এবং গ্রামে ‘আলোঘর’ নামে একটি সংগঠন চালায়। সেখানে মেয়েরা বসে নিজেদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে, সমাধান খোঁজে।
তন্বী বলে, “আমার মা বলেছিলেন, আমার জীবন আমারই। তাই আমি ‘না’ বলেছিলাম।” এমন গল্প আজ সুনামগঞ্জ, পিরোজপুর, ঝিনাইদহসহ নানা জায়গায়। মেয়েরাই এখন নিজেদের রক্ষা করছে, অন্যদের সচেতন করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রী রোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান ডা. সেহেরীন এফ. সিদ্দিকা বলেন, ১০ থেকে ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত সময়টা হলো এক তরুণীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। এই ট্রানজিশনকে কেন্দ্র করেই তাদের শরীর ও মনের ওপর আসে নানান পরিবর্তন। এই বয়সটা ভালোভাবে না কাটলে মেয়েরা মূল্যবান সম্পদে পরিণত হতে পারে না।
সিরাক বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এসএম সৈকত বলেন, ‘নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে নীরবতা ভাঙতে হবে। সচেতনতা, নারীবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।
নারীপক্ষের সদস্য জাহানারা খাতুন বলেন, ‘আমাদের কন্যাশিশুরা এখনও নিরাপত্তা, শিক্ষা ও পুষ্টির মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। শুধু আইন নয়, দরকার সামাজিক মনোভাবের পরিবর্তন। মেয়েদের সক্ষমতা বোঝা ও তাদের কণ্ঠকে গুরুত্ব দেওয়া এখন সময়ের দাবি।’