বাংলাদেশ এক দুর্যোগপ্রবণ দেশ—এ কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এ কথার পেছনে যে বাস্তবতা লুকিয়ে আছে, তা অনেক বেশি কঠিন। প্রায় প্রতি বছরই কোনো না কোনো প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ে দেশজুড়ে জীবন থমকে যায়। কোথাও বন্যা, কোথাও অগ্নিকাণ্ড, কোথাও আবার ঝড় কিংবা বজ্রপাত—সব মিলিয়ে দুর্যোগ যেন আমাদের জীবনেরই এক অংশ হয়ে উঠেছে।
তবুও আশার জায়গা আছে—বাংলাদেশের মানুষ এখনো মানুষের পাশে দাঁড়ায়। দুর্যোগ নামলেই অসংখ্য হাত এগিয়ে আসে। তবে এই মানবিকতা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন শক্ত প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়। দুঃখজনকভাবে, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও সেই সমন্বয় আমরা ঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারিনি। ফলে প্রতিবার দুর্যোগের সময় দেখা যায় বিশৃঙ্খলা, দায়িত্বের দ্বন্দ্ব আর দেরি।
আজ ১৩ অক্টোবর, আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য—“সমন্বিত উদ্যোগ, প্রতিরোধ করি দুর্যোগ।” ১৯৮৯ সাল থেকে দিনটি বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে মানুষকে দুর্যোগের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করতে। বাংলাদেশও নিয়মিতভাবে এ দিবস পালন করে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—শুধু দিবস পালন করলেই কি বাস্তবে দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত?
বন্যা: সবচেয়ে পুরনো, সবচেয়ে ঘনঘন
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়। বড় ধরনের বন্যা হলে দেশের অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চল পানির নিচে চলে যায়। মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তিনটি প্রধান নদী দিয়ে প্রবাহিত হয় গড়ে ৮ লাখ ৪৪ হাজার মিলিয়ন ঘনমিটার পানি। বন্যা মানেই শুধু পানির চাপ নয়—তার সঙ্গে আসে আশ্রয়ের সংকট, ত্রাণ বিতরণের বিশৃঙ্খলা, রোগব্যাধি আর প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলাও।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক সময় দেখা যায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা থাকলেও মানুষ সেখানে যেতে চায় না। কেউ গবাদি পশু রেখে যেতে ভয় পায়, কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করে। আবার ত্রাণ ঠিকভাবে পৌঁছালেও বিতরণের জায়গায় অভিযোগ ওঠে। কার দায়িত্ব কী, সেটা স্পষ্ট না থাকলে পুরো ব্যবস্থাটাই দুর্বল হয়ে পড়ে।
দুর্যোগ বিশ্লেষক গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, “আমাদের মূল সমস্যা সমন্বয়ের অভাব। কাজটা শুধু ফাইলপত্রে বা অফিসের টেবিলে নয়, মাথায় রাখতে হবে। দুর্যোগের সময় সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে, কিন্তু সেটা আমরা করি না। সারা বছর আলাদা আলাদা কাজ করি, আর বিপর্যয় এলে একসাথে হতে চাই—এভাবে কার্যকর ফল পাওয়া যায় না।”
তিনি আরও বলেন, “যে কোনো দুর্যোগে প্রথমে ঠিক করতে হবে—কে নেতৃত্ব দেবে। একজন ‘কোর কমান্ডার’ থাকতে হবে, যার সিদ্ধান্তেই সব কাজ এগোবে। না হলে কমান্ড ঠিক করতে করতে দুর্যোগই শেষ হয়ে যায়।”
অগ্নিকাণ্ড: নিত্যদিনের আতঙ্ক
দুর্যোগের তালিকায় বন্যার পরেই আছে অগ্নিকাণ্ড। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, শুধু ২০২৪ সালেই দেশে ২৬ হাজার ৬৫৯টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে—অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৭৩টি করে আগুন! এতে ১৪০ জন নিহত এবং ৩৪১ জন আহত হয়েছেন।
আগুন লাগার সবচেয়ে বড় কারণ—বৈদ্যুতিক গোলযোগ, অসাবধানভাবে ফেলে দেওয়া বিড়ি-সিগারেটের টুকরা, গ্যাস লিকেজ, আর চুলার অসতর্ক ব্যবহার। রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’-এর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এখনো অনেকের মনে তাজা ক্ষত।
ডিজাস্টার ফোরামের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের প্রথম পাঁচ মাসেই আগুনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে—জানুয়ারিতে ২,৫৪১টি, ফেব্রুয়ারিতে ২,৭৩৭টি, মার্চে ৩,৪২১টি এবং এপ্রিলে ৩,৪২৬টি। অর্থাৎ প্রতি মাসেই দু’হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ড!
সমন্বয়ের ঘাটতি: অদৃশ্য দুর্যোগ
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সালাহউদ্দীন আল ওয়াদুদ বলেন, “দুর্যোগ মোকাবিলা কোনো একক সংস্থার কাজ নয়। সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, জনপ্রতিনিধি—সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা সেখানে কিছুটা পিছিয়ে আছি।”
তিনি জানান, “আমাদের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা আছে, জনবল কম, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবও আছে। ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকলেও তাদের নিয়মিত মহড়া হয় না—এটাই বড় ঘাটতি।”
বাংলাদেশের মানুষ দুর্যোগের মুখে সাহসী, পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু সেই মানবিক শক্তিকে কার্যকর ব্যবস্থাপনায় রূপ দিতে না পারলে প্রতি বছরই আমাদেরকে নতুন করে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমরা ঠেকাতে পারব না—কিন্তু একে প্রশমন করার ক্ষমতা আমাদের হাতেই।
আর সেই ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি একটাই—সমন্বিত উদ্যোগ।
যখন সবাই মিলে একসাথে কাজ করবে, তখনই সত্যিকার অর্থে দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ হবে একটি প্রস্তুত জাতি।

