নির্যাতনের শিকার হলেও কোথায় অভিযোগ করা যায়, তা দেশের অর্ধেকের বেশি নারীই জানেন না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) সাম্প্রতিক জরিপে এই উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে।
জরিপে অংশ নেওয়া নারীদের মধ্যে মাত্র ৪৮.৫ শতাংশ জানেন, সহিংসতার শিকার হলে কীভাবে বা কোথায় অভিযোগ করতে হবে। যারা জানেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানোর কথা উল্লেখ করেছেন।
গত সোমবার রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। দেশব্যাপী ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ২৭,৪৭৬ জন নারী সাক্ষাৎকারে অংশ নেন। এর আগে ২০১১ এবং ২০১৫ সালে অনুরূপ জরিপ করা হয়েছিল। জরিপে দেখা গেছে, সমাজের সব স্তরের নারী—বস্তিবাসী, দুর্যোগপ্রবণ এলাকা এবং প্রতিবন্ধী নারীরাও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।
জরিপে উঠে এসেছে, বিশেষায়িত সেবা সম্পর্কেও নারীদের সচেতনতা খুবই কম। মাত্র ২.২ শতাংশ নারী ‘ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’ সম্পর্কে জানেন। শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের মধ্যে মাত্র ৯.৩ শতাংশ সরকারি হেল্পলাইন ১০৯ সম্পর্কে সচেতন, যা সহিংসতা থেকে মুক্ত নারীদের (১৫.৭ শতাংশ) চেয়েও কম।
তালাকপ্রাপ্ত ও বিধবা নারীর মধ্যে এই সচেতনতা আরও কম—মাত্র ৩.৩ শতাংশ হেল্পলাইন সম্পর্কে জানেন। অনেকে জানালেন, বহু বছর পরও তারা বুঝেছেন কোথায় সহায়তা পাওয়া যায়।
দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা অত্যন্ত ব্যাপক। প্রতি চারজন নারীর মধ্যে তিনজন (৭৬ শতাংশ) জীবনের কোনো না কোনো সময়ে তাদের সঙ্গীর দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন। গত এক বছরে প্রায় অর্ধেক নারী (৪৯ শতাংশ) এই ধরনের সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে নারীদের ব্ল্যাকমেইল করার ঘটনাও বেড়েছে; ৮.৩ শতাংশ নারী প্রযুক্তি-নির্ভর সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
নারীদের মধ্যে অভিযোগ করার প্রবণতা খুব কম। প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে দুইজন (৬৪ শতাংশ) তাদের নির্যাতনের কথা কাউকে বলেন না। যারা জানিয়েছেন, তাদের ৭৮.৮ শতাংশ বাবা-মা, ৩৫.২ শতাংশ শ্বশুরবাড়ির লোক এবং ৩২.৮ শতাংশ ভাইবোনকে জানিয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা চেয়ে নারীরা সামাজিক সমাধানকে বেশি ভরসা করেন। যারা প্রতিকার চেয়েছেন, তাদের ৫৮.৪ শতাংশ স্থানীয় নেতার কাছে গেছেন, ৩৬.২ শতাংশ পুলিশের কাছে, আর ১৫ শতাংশ আদালতে।
অভিযোগ না করার প্রধান কারণগুলো হলো— সহিংসতাকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়া (৩৮.৮%), পারিবারিক সম্মান হারানোর ভয় এবং সামাজিক লজ্জা। ফলে অনেক নারী নীরব থাকতে বাধ্য হন।
গত এক বছরে সহিংসতার শিকার নারীদের মধ্যে মাত্র ১৪.৫ শতাংশ চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৯৩ শতাংশ শারীরিক আঘাতের জন্য এবং ১৫.৫ শতাংশ মানসিক সমস্যার জন্য চিকিৎসা পেয়েছেন।
জরিপে দেখা গেছে, নারীদের প্রতি সহিংসতায় প্রধানভাবে স্বামী দায়ী। সাধারণত ঘটছে— চলাচলে বিধিনিষেধ (৬৮%), শারীরিক নির্যাতন (৪৭%), মানসিক নির্যাতন (৩৭%), এবং যৌন নির্যাতন (২৯%)।
শারীরিক নির্যাতন প্রায়শই পুনরাবৃত্তিমূলক। ২৯.৪ শতাংশ নারী ছয় বা তার বেশি বার শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যৌন সহিংসতায়ও প্রায় ২৬ শতাংশ নারী স্বামীর দ্বারা জোরপূর্বক মিলনের শিকার হয়েছেন, যার অর্ধেকেরও বেশি ঘটনা বারবার ঘটেছে। গর্ভাবস্থায়ও ৭ শতাংশ নারী শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
১৫-১৯ বছর বয়সী বিবাহিত কিশোরীরা সহিংসতার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন। গত এক বছরে সঙ্গীর দ্বারা নির্যাতনের শিকারদের ৬২ শতাংশ এই বয়সী। শহরে বসবাসকারী নারী ৩৫ শতাংশ, বস্তিবাসী নারী ৪৭ শতাংশ বেশি ঝুঁকিতে।
শারীরিক নির্যাতনে খুলনা বিভাগ শীর্ষে (৫৭.২%), যৌন নির্যাতনে বরিশাল শীর্ষে (৩৬%), আর সিলেট ও ময়মনসিংহ সর্বনিম্ন।
-
স্বামীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক: সহিংসতার ঝুঁকি ২.৩ গুণ
-
মাদকাসক্তি: ১.৭ গুণ
-
যৌতুকবিহীন বিয়ে: ১.৮ গুণ
শিক্ষা ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে—যদি স্বামী মাধ্যমিক পাস, ঝুঁকি ১৭% কম; বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া স্বামীর ক্ষেত্রে ৩২% কম।
অর্থ উপার্জনকারী নারীরা স্বামীর দ্বারা ২৮ শতাংশ বেশি সহিংসতার শিকার হন, যা জেন্ডার ভূমিকার পরিবর্তনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ধরা হয়।
বিয়ের বাইরে শাশুড়ি (৩৫%), মা (২০.৫%), দেবর বা ননদ (২৯%) এবং অন্যান্য পুরুষ (৩৪%) শারীরিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে মূল হোতা। যৌন সহিংসতার ক্ষেত্রে স্বামী-নন আত্মীয়, বন্ধু বা পরিচিতদের ভূমিকা বেশি দেখা গেছে।
জরিপে স্পষ্ট হয়েছে, নারীদের প্রতি সহিংসতা ব্যাপক এবং পুনরাবৃত্তিমূলক। সচেতনতা বাড়ানো, নিরাপদ অভিযোগ ব্যবস্থার প্রসার এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা নিশ্চিত করা দেশের নারীদের সুরক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক।