ভোলা শহরের হৃদয়ে অবস্থিত দুই শতাধিক বছরের পুরোনো বাংলা স্কুল পুকুর এখন দখলদারদের কবলে। এই ঐতিহাসিক জলাশয় ভরাট করে একের পর এক বহুতল ভবন উঠছে। দুই দশক ধরে সচেতন নাগরিক সমাজ দখলমুক্ত করার দাবি জানালেও প্রশাসনের তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
গত বছরের ৫ আগস্টের পরও পুকুরের তীর ভরাট করে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এটি সম্পূর্ণ বেআইনি। শহরের মানুষ এই পুকুরের পানি দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করে এবং অগ্নিকাণ্ডের সময় এখানকার পানি দিয়েই আগুন নেভানো হয়। কিন্তু নিয়মিত দখল ও ভরাটের কারণে জলাশয়টি দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। স্থানীয়দের মতে, এটি শুধু একটি পুকুর নয়, ভোলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক, যা এখন বিলুপ্তির পথে।
ভোলা শহরের মাঝখানে অবস্থিত শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়ের পুকুরটি স্থানীয়ভাবে ‘বাংলা স্কুল পুকুর’ নামে পরিচিত। একসময় এটি ছিল শহরের সবচেয়ে বড় ও গভীর পুকুর। দুই পাশে পাকা ঘাট, স্বচ্ছ পানি, সকাল-বিকেলে সাঁতার—সব মিলিয়ে ছিল এটি শহরের প্রাণকেন্দ্র। এখন সেই চিত্র আর নেই। চারপাশে দোকান, অফিস ও বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। কেউ ইজারা নিয়ে, কেউ প্রভাব খাটিয়ে পুকুর দখল ও দূষণ করছে।
ভোলা পৌর ভূমি কার্যালয়ের নথি অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালে চরজংলা মৌজার ১৬৪ নম্বর খতিয়ানের ছয়টি দাগে ১ একর ৩৫ শতাংশ জমি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ‘ক’ তালিকাভুক্ত হয়। এর মধ্যে একটি দাগে ছিল ৯৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ পুকুরের জমি, আর দুটি দাগে ৯ দশমিক ৪০ শতাংশ তীরের জমি। মোট আয়তন ছিল ১ একর ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। এখন তা কমে প্রায় ৭০ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জমি দখল বা ভরাট হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, ২০০১ সালে বিএনপি সরকারের সময় আমেনা প্লাজা নির্মাণের মধ্য দিয়ে দখলের শুরু। এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ভবনের কিছু অংশ ভাঙা হলেও আওয়ামী লীগের প্রথম মেয়াদে দক্ষিণ ও পশ্চিম তীর দখল করে আরও কয়েকটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়। সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয় একাধিকবার সীমানা নির্ধারণ করলেও অদৃশ্য কারণে সেই সীমারেখা অতিক্রম করে ভবন উঠেছে। সচেতন সমাজের কিছু অংশ দখলদারদের সঙ্গে সমঝোতায় গেলে আন্দোলনও স্তিমিত হয়ে পড়ে।
সোমবার সরেজমিন দেখা যায়, পুকুরের পূর্ব-দক্ষিণ থেকে পশ্চিম পাশে শিক্ষক সমিতির কার্যালয়, বিএফসি, বাংলাদেশ রাইফেলস ক্লাব, নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ কার্যালয়, স্কাউটস ভবন, চেম্বার অব কমার্স, বাংলা পয়েন্ট, ময়ফুল গার্ডেন, একে কমপ্লেক্স, ফরিদা মঞ্জিল, সেলিম শপিং সেন্টার, গোলদার প্লাজা ও আমেনা প্লাসহ একাধিক স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এসব ভবনের অধিকাংশই পুকুরের তীর দখল করে নির্মিত। ভূমি অফিসের তথ্য বলছে, এক বছরের ইজারা নিয়ে এসব স্থাপনা গড়া হয়েছে।
দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় নয়ন গং ও নান্নু গং ২ দশমিক ২৩ শতাংশ জমি ইজারা নিয়ে প্রায় দ্বিগুণ জায়গায় ভবন তুলেছেন। রাতে গোলদার প্লাজা ও আমেনা প্লাজার পশ্চিম তীরে ইট-সুরকি ফেলে দখল চলছে। নান্নু মিয়া বলেন, “সবাই এক বছরের লিজ নিয়ে ভবন তুলেছে, আমরা তুললে দোষ কী? তাছাড়া ওখানে আমাদের নিজের জমিও আছে।”
বাংলা স্কুলের সাবেক ছাত্র ও জীবন পূরাণ আবৃত্তি একাডেমির পরিচালক মো. মশিউর রহমান বলেন, “আমাদের শৈশব-যৌবন কেটেছে এই পুকুরে সাঁতার কেটে। এর তীরেই আমাদের সংস্কৃতিচর্চা। এই পুকুর হারালে আমাদের স্মৃতিও হারাবে। প্রশাসন রহস্যজনকভাবে নীরব।”
ভোলা নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব এস এম বাহাউদ্দিন জানান, ২০০৪-০৫ সাল থেকে নাগরিক সংগঠনগুলো পুকুর রক্ষায় আন্দোলন করছে। বিক্ষোভ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি, সংবাদ সম্মেলন—সবই হয়েছে। তবু প্রশাসনের কোনো বাস্তব পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ভোলা জেলা শাখার সভাপতি মো. মোবাশ্বির উল্লাহ চৌধুরী বলেন, “আমরা প্রায় ২০ বছর ধরে লড়ছি। দখলকারীরা রাতে মাটি ফেলে দখল করছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে পুকুরটি মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যাবে।”
পরিবেশবাদীরা জানান, গত ৩০ বছরে ভোলা শহরের শতাধিক পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনের কোর্ট মসজিদ পুকুরের অর্ধেক ইতিমধ্যে ভরাট হয়েছে। এখন কেবল বাংলা স্কুল, জেলা পরিষদ ও সরকারি স্কুলের পুকুর টিকে আছে। এগুলো রক্ষা না পেলে অগ্নিকাণ্ডে পানিসংকট, জলাবদ্ধতা ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়বে। শহর হারাবে তার ঐতিহ্য ও নিরাপত্তা।
ভোলার জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান বলেন, “সরকারি পুকুর দখল করার অধিকার কারও নেই। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। এসি ল্যান্ড ও ইউএনওকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং পুকুরটি দখলমুক্ত করা হবে।”