প্রবাসীরা শুধু অর্থ পাঠান না বা ছুটিতে দেশে ফেরেন না; তাঁদের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক আবেগ, রাজনৈতিক উদ্বেগ ও ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় গভীরভাবে জড়িত। তাই নির্বাচন কমিশন যখন ঘোষণা দিয়েছে যে বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরাও জাতীয় নির্বাচনে ডাক-ভোটে অংশ নিতে পারবেন—‘Postal Vote BD’ অ্যাপের মাধ্যমে—এটি কেবল প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয় বরং একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
বেশিরভাগ দেশেই প্রবাসীরা আগেভাগে ভোট দেন বা ডাক-ভোটে অংশ নেন। এতে তাঁদের ভোটাধিকার বজায় থাকে, যদিও অংশগ্রহণের হার তুলনামূলকভাবে কম। যেমন সুইডেনে বিদেশে থাকা নাগরিকেরা কনস্যুলেটে ভোট দেন বা ডাক-ব্যবস্থায় ব্যালট পাঠান। তবে নির্বাচনের দিন সরাসরি অন্য দেশে বসে ভোট দেওয়া সাধারণত সম্ভব নয়।
বাংলাদেশও এবার সেই পথে এগোচ্ছে। ‘Postal Vote BD’ অ্যাপ চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে চালু হওয়ার কথা। এর মাধ্যমে প্রবাসীরা নিবন্ধন ও ভোট দিতে পারবেন। তবে এখনো স্পষ্ট নয়—এই ব্যবস্থার নিরাপত্তা, তদারকি ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করবে।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, প্রতিটি ডাক-ভোট ব্যালটে প্রায় ৭০০ টাকা খরচ হবে। ৫০ লাখ প্রবাসী ভোটারকে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য ধরা হয়েছে, যা বিশাল ব্যয়ের ইঙ্গিত দেয়। সরকার বলেছে, ভোটারদের কোনো খরচ বহন করতে হবে না।
তবে প্রশ্ন উঠছে—একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে এই বিপুল অর্থ শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা গণপরিবহনে ব্যয় করা কি আরও ফলপ্রসূ নয়?
যাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ‘লক’ বা ‘সাসপেন্ড’ রয়েছে, তাঁরা এই প্রক্রিয়ায় ভোট দিতে পারবেন না। কিন্তু বাস্তবে এটি প্রয়োগের সময় রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হতে পারে। ইতিমধ্যেই কিছু প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের এনআইডি লক করা হয়েছে। এই জটিলতা দ্রুত সমাধান না হলে অনেক প্রবাসী ভোটার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
বাংলাদেশের নির্বাচনে দীর্ঘদিন ধরে মনোনয়ন-বাণিজ্য, অর্থের প্রভাব এবং প্রার্থীদের সম্পদ বৃদ্ধির মতো বিষয় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, প্রার্থীরা মনোনয়ন পেতে বিপুল অর্থ ব্যয় করেন। ফলে প্রশ্ন ওঠে—
প্রবাসীরা তাঁদের সময় ও অর্থ ব্যয় করে যদি দুর্নীতিগ্রস্ত বা অযোগ্য প্রার্থীকেই ভোট দেন, তবে সেটি কতটা যুক্তিসংগত?
ডাক-ভোটে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো নিরাপত্তা। ব্যালট পাঠানো ও ফেরত আসার পুরো প্রক্রিয়া কীভাবে তদারক হবে? আন্তর্জাতিক ডাক-বিলম্ব বা হারানোর ঝুঁকি কীভাবে সামলাবে নির্বাচন কমিশন? পাশাপাশি অ্যাপভিত্তিক নিবন্ধনে সাইবার ঝুঁকিও বড় উদ্বেগের বিষয়। ডেটা চুরি, ম্যালওয়্যার আক্রমণ বা পরিচয় জালিয়াতি ঠেকাতে কী নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটি এখনো অস্পষ্ট।
আরেকটি ঝুঁকি হলো ভোট বিক্রি বা টিকিট-বাণিজ্য। প্রবাসীদের ভোট যদি আর্থিকভাবে প্রভাবিত হয়, তাহলে গণতন্ত্র আরও দুর্বল হতে পারে।
লক্ষ কোটি টাকার এই উদ্যোগ যদি রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন না করে, তবে তা নৈতিকভাবে কতটা সঙ্গত—এ প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাসীদের ভোটাধিকার অবশ্যই গণতান্ত্রিক ন্যায্যতার অংশ। কিন্তু সুযোগ-খরচের দিকও ভাবতে হবে—এই অর্থ দিয়ে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা সড়ক খাতেও বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব।
তাই প্রয়োজন একটি স্বচ্ছ, ধাপে ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য কৌশল, যেখানে নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত থাকবে।
কী করা প্রয়োজন
- প্রার্থীদের সম্পদ, ট্যাক্স, মামলা ও দায়-দেনার তথ্য অনলাইনে উন্মুক্ত করা।
- দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্র নিশ্চিত করা এবং টাকার প্রভাব বন্ধ করা।
- ‘Postal Vote BD’ চালুর আগে সীমিত আকারে পরীক্ষামূলক পাইলট প্রকল্প চালানো।
- ব্যালট পরিবহনে ট্র্যাকিং নম্বর ও নিরাপদ চেইন-অফ-কাস্টডি ব্যবস্থা করা।
- দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
- প্রবাসীদের সচেতন করতে দূতাবাস, সংগঠন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা বাড়ানো।
এসব বাস্তবায়ন না হলে প্রবাসী ভোট কার্যক্রম রাজনৈতিক ঝুঁকি ও অর্থনৈতিক বোঝায় পরিণত হতে পারে।
সুইডেনসহ অন্যান্য দেশে থাকা প্রবাসীরা তাঁদের এনআইডি ও পাসপোর্ট হালনাগাদ রাখুন। কনস্যুলেটের ঘোষণায় সতর্ক থাকুন এবং প্রার্থীদের অতীত, নীতিবোধ ও দায়বদ্ধতা যাচাই করে ভোট দিন।
যদি বাংলাদেশ এই প্রক্রিয়া সঠিকভাবে ডিজাইন করতে পারে, তাহলে প্রবাসী ভোট অংশগ্রহণ গণতন্ত্রে নতুন দিগন্ত খুলবে। তবে তা নির্ভর করবে বিশ্বাস ও স্বচ্ছতার ওপর।
প্রবাসীদের ভোটাধিকার গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তা শুধু আনুষ্ঠানিক সুযোগ নয়—এটি দেশের ভবিষ্যতের সঙ্গে নৈতিক সম্পর্কের বিষয়। যদি যোগ্য প্রার্থী না থাকেন, তবে সেই ভোট অর্থহীন। তাই প্রার্থী নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও নৈতিকতা নিশ্চিত করাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ।
গণতন্ত্র টিকে থাকবে তখনই, যখন প্রবাসীরা সচেতন ও বিবেকনির্ভর সিদ্ধান্ত নেবেন।