গতকাল পালিত হয়েছে বিশ্ব মান দিবস। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘সমন্বিত উদ্যোগে টেকসই উন্নত বিশ্ব বিনির্মাণে মান’। এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশেও নানা আয়োজন করা হয়েছে। দিবসের মূল লক্ষ্য হলো ভোক্তাদের পণ্য ও সেবার মান বিষয়ে সচেতন করা।
কিন্তু বাস্তবতায় বাংলাদেশে সচেতনতা ও মান নিয়ন্ত্রণ কাঠামো কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে দেশ অনেক পিছিয়ে। অনেক পণ্যে মান সনদ বাধ্যতামূলক না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীদের সুযোগ তৈরি হয়। বাজারে নকল ও ভেজাল পণ্যের প্রাচুর্য দেখা দেয়। এতে কোম্পানি ও ভোক্তারা উভয়েই বিপাকে পড়েন। স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে। তাই বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) অনুমোদনহীন পণ্য বন্ধ করে জনস্বাস্থ্যে সংবেদনশীল পণ্যে মান সনদ বাধ্যতামূলক করা জরুরি।
মান সনদের বাধ্যবাধকতা না থাকায় বাজারে ভেজাল ও মানহীন খাদ্যপণ্যের সয়লাব দেখা যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে অনেকবার ভেজাল, ক্ষতিকর রাসায়নিক, ভুল সংরক্ষণ ও পরিবহনের কারণে খাদ্যের গুণগত মান নষ্ট হয়। প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রেও মান নিয়ন্ত্রণ কার্যকরভাবে হচ্ছে না। যা মান সনদের আওতায় রয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রেও প্রশ্ন রয়েছে।
দেশের খাদ্য ও পণ্যের আন্তর্জাতিক মান সংস্থার (আইএসও) নির্ধারিত মানদণ্ড পূরণে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মান নিয়ন্ত্রণ কাঠামো দুর্বল। সম্প্রতি ইকোনমিস্ট ইমপ্যাক্টের প্রকাশিত গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্সে দেখা যায়, খাদ্যনিরাপত্তায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩ দেশের মধ্যে ৮০তম। পণ্যের গুণমান ও নিরাপত্তায় ৭১তম অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশে ভারত, মিয়ানমার, ভিয়েতনামের মতো দেশ এগিয়ে আছে। উন্নত দেশগুলোতে খাদ্যের নিরাপত্তা, লেবেলিং, প্যাকেজিং ও মান পরীক্ষায় কঠোর নিয়ম অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশে বিষয়টি বরাবরই অবহেলিত থেকে গেছে।
বাংলাদেশে পণ্য বা সেবার মান নির্ধারণ ও তদারকি করে তিনটি প্রতিষ্ঠান—বিএসটিআই, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। বিএসটিআই আন্তর্জাতিক মান সংস্থা (আইএসও) এবং দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক মান সংস্থাসহ আটটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য। সংস্থাটি বাজারে মানহীন ও ভেজাল খাদ্যপণ্য প্রবেশ ঠেকাতে পারছে না। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বিএসটিআই চার দশকে ৪ হাজার ৫৭৪টি পণ্যের মান নির্ধারণ করেছে, যার মধ্যে মাত্র ৩১৫টি পণ্যে বাধ্যতামূলক সনদ রয়েছে। কসমেটিকস, মসলা ও খাদ্যপণ্যের মতো জনস্বাস্থ্যে সংবেদনশীল পণ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়নি।
দেশে হাজারের অধিক খাদ্যপণ্য রয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৬০-৬৫টি পণ্যকে বাধ্যতামূলক সনদ দেওয়া হয়েছে। শতাধিক পণ্য রয়েছে স্বেচ্ছামূলক সনদের আওতায়। সনদের বাইরে থাকা পণ্যগুলো বাজারে বিক্রি হচ্ছে বাধ্যতামূলক না থাকার অজুহাতে। মসলাজাতীয় পণ্যে কিছু বড় প্রতিষ্ঠান বাধ্যতামূলক বিএসটিআই লোগো ব্যবহার করে কিন্তু অনেক পাইকারি ও খুচরা দোকানে বিক্রি হচ্ছে কোম্পানির নামবিহীন পণ্য। বিএসটিআই ছয়টি মসলাজাতীয় পণ্যকে বাধ্যতামূলক করেছে। স্বেচ্ছামূলক সনদের আওতায় রয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি পণ্য। কিন্তু বাজারে শতাধিক মসলাজাতীয় পণ্য বিক্রি হচ্ছে।
কসমেটিকস বাজারে সবচেয়ে বেশি ভেজাল ও মানহীন পণ্য পাওয়া যায়। ১০৬টি কসমেটিকস পণ্যে সনদ দেওয়া হলেও মাত্র ৩০টির জন্য এটি বাধ্যতামূলক। বিক্রেতারা জানান, বাজারে পাঁচ শতাধিক কসমেটিকস পণ্য বিক্রি হচ্ছে। নিম্নমানের এসব পণ্যে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, রেটিনাইল পালমিটেট, মারকিউরাস ক্লোরাইড, ক্যালোমেল ব্যবহার হয়। বিএসটিআই শুধুমাত্র সিসা (লেড) ও পারদের (মার্কারি) মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। অনেক কসমেটিকস চোরাইপথে বিদেশ থেকে আসে ও আমদানি নীতিবহির্ভূতভাবে বিক্রি হয়।
খাদ্য ও পণ্যের ভেজাল প্রতিরোধে ভোক্তা অধিকার ও বিএসটিআই অভিযান চালায়। তবে অপরাধীরা কিছুদিন পরপরই একই কাজ করছেন। নতুন ভেজাল পণ্যের প্রতিষ্ঠানও তৈরি হচ্ছে। চকচকে মোড়কে বিক্রি হয়, ক্রেতারা উচ্চমূল্যে কিনছেন। আইনের দুর্বল প্রয়োগ জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। দুধ, তেল, মিষ্টি, মসলা, মাছ-মাংস, পানীয়—প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যে ভেজালের অভিযোগ আছে।
ভেজাল ও মানহীন খাদ্য স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করছে। দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ক্ষতি করছে ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইডের মতো রাসায়নিক। নিয়মিত গ্রহণে পাচনতন্ত্র, লিভার, কিডনিতে সমস্যা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার ও হরমোনজনিত রোগ বাড়ছে।
ভেজাল ও মানহীন খাদ্য ও পণ্যের বিস্তার রোধে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো দরকার। ল্যাবরেটরি সক্ষমতা ও জনবল বাড়ানো, প্রযুক্তিনির্ভর মান নিরীক্ষা জরুরি। ভেজাল ও মানহীন পণ্য শুধু জনস্বাস্থ্যের হুমকি নয়, দেশের সুনামও ক্ষুণ্ন করে এবং রফতানির সুযোগ সংকুচিত করে। তাই মান নিশ্চয়তার প্রশ্নে কঠোর অবস্থান নেওয়া আবশ্যক।